সোমবার, ৩০ মার্চ, ২০২০

প্রবন্ধ : শঙ্কর ব্রহ্ম



                             প্রসঙ্গ: কবিতা ভাবনা
                                  শঙ্কর ব্রহ্ম


এক.

"কবি কোন তকমা নয় 
কবি বিশেষ এক পরিচয়,
মনের ভাব যার কথায়
ছন্দে চিত্রে প্রকাশ পায়।"
                    সব বিদ্যে শেখানো যায়,
কবিতা লেখা শেখানো যায় না।
                       ওটা যার হয় তার হয়,
ভিতরের ব্যাপার( অনুভূতির তীব্র আবেগে, প্রকাশের তাগিদ)।
    তবে আজকাল বানানো কবিতার ছড়াছড়ি,চোখে পড়ে যার মধ্যে প্রাণের স্পর্শ পাওয়া যায় না।
        কবিতা আসে স্বতস্ফূর্ত ভাবে,
ছন্দ মাত্রা তাল লয় ভেবে আসে না।
কবি অনেক সময় তা নিয়ন্ত্রণ করে,
তার জ্ঞান বুদ্ধি শিক্ষা দিয়ে,কবিতা সে নিয়ন্ত্রণে,অনেক সময় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
ভিতরে কবিত্ব বোধ থাকলে তবেই হবে
নতুবা সবটাই যাবে ফাঁকি।
      বিদেশে কবিতা লেখা শেখাবার কিছু স্কুল আছে,সেখানে লেখা শিখে কেউ বড় কবি হতে পেরেছেন বলে শোনা যায়নি।
                কবি সুনীল গাঙ্গুলী ,সমরেন্দ্র সেনগুপ্তরাও কলকাতায় সে রকম একটা প্রচেষ্টা করেছিলেন ,কৃত্তিবাস পত্রিকার পক্ষ থেকে , সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি।
   তারা কোন সৃষ্টিশীল কবি তৈরী করতে পারেননি,সেই পরিকল্পনা থেকে,ফলে তা অল্পকালের মধ্যেই পরিত্যাজ্য হয়।
             ফরাসী কবি মালার্মে বলেছেন ,
কবি আসলে নিজের সাথে কথা বলে,
পাঠক শ্রোতারা আড়ি পেতে তা শোনেন।

দুই.


দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে কবিতার সঙ্গে সহবাস আমার,তবু কতটুকু বুঝতে বা জানতে পেরেছি তাকে?
               স্পষ্ট করে বলতে পারব না।
সে আজও আমার কাছে সম্পূর্ণ রহস্যময়,
আগের মতো সমান আকর্ষণীয়।
                     তবু যতটুকু বুঝেছি তাকে,
তা নিয়ে কিছু বলাটা বোধহয় অসমীচীন হবে না।
         অন্য কোন কবির, কবিতা লেখার পদ্ধতির কথা জানি না।
    তবে, নিজের লেখার পদ্ধতি নিয়ে কিছু কথা বলতে পারি,যা একান্ত ব্যক্তিগত,যদি কারও কোন উপকারে আসে, তাই বলা।
          আমি কোন কবিতা লিখি না,বরং কবিতাই আমাকে দিয়ে কিছু লিখিয়ে নেয় ,কেমন করে তাও বলি শুনুন।
    এক একটা পংক্তি এসে কোথা থেকে মাথায় ঢুকে পড়ে, আচমকাই।
      তারপর সেটা মনে মনে লালন করার পর্ব শুরু হয়,দ্বিতীয় পংক্তির জন্য প্রার্থনা চলে,মনে মনে।সেটা কখন আসবে তা কেউ জানে না।
   আমি মনেকরি, কবিতা লেখা পার্টটাইম জব নয়,ফুলটাইম ওয়ার্ক।নিরবিচ্ছিন্ন ব্যাপার,ভোরে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা থেকে শুরু হয় ,তারপর ঘুমের আগে অবধি চলে কবিতা সৃজনের কাজ মনে মনে।ঘুমের ভিতরও অনেক সময় চলে স্বপ্নে।
       অনেক সময় মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে,হঠাৎ একটা পংক্তি এসে বিরক্ত শুরু করে,সকালে উঠে আর সেটা মনে থাকে না,তাই আমি তখনই পংক্তিটি লিখে রাখার চেষ্টা করি আজকাল।হাতের কাছে যা পাই তাতেই লিখে রাখি তখনকার মতো,প্রেসক্রীপশনের উল্টো পিঠে, ক্যালেন্ডারের ছেঁড়াপাতায়,লন্ড্রির বিল,কিংবা কিছু কেনাকাটার রসিদ ইত্যাদি হাতের কাছে যা পাই তাতেই।
      সকালে উঠে, প্রাত্যহিক কাজ-কর্ম সেরে,চায়ে চুমুক দিতে দিতে,পংক্তিটি মনে মনে আওড়াই বার কয়েক।
         ভিতরে ভিতরে কবিতাটি লেখার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় মনে মনে।
      সব সময় সফল হই তা নয়, প্রায়শই বিফল হই,কখনও সখনও সফলতা আসে তার অনুগ্রহ পেলে।লেখাটা পূর্ণতা পায়।
       নিজের মনপূত না হলে, তার উপরও  কাঁটাকাটি চলে,যতক্ষণ না পর্যন্ত মন
তুষ্টি হয়।এইভাবেই আমার কবিতা লেখার প্রক্রিয়া চলে,বলা যায়।
      কবিতার নিজস্ব একটা ভাষা আছে , তা আয়ত্ব করতে বহুদিন সময় লাগে,
দেশী বিদেশী ভাল ভাল কবিতা পড়তে হয় বারবার,অনুসন্ধিৎসু থাকতে হয় মনে মনে, পূর্বসূরীদের লেখা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা একান্ত জরুরী,হঠাৎ ভূঁই ফোড়ের মতো কিছু হয় না।
   ভাবতে হয় সে'সব লেখা নিয়ে নিয়মিত, দীর্ঘদিন এ'রকম প্রচেষ্টার ফলে, তা কিছুটা আয়ত্বাধীন হয়।
তারপর চলে নিজের মতো করে পরীক্ষা নীরিক্ষার কাজ।সেটা মোটেই সহজ  ব্যাপার নয় ।
হঠাৎ করে এসব আয়ত্ব করা যায় না।
যারা এ'কথা বোঝেন না, কিংবা মানেন না,তাদের কবিতা লেখার প্রচেষ্টা, ছন্দ মিলিয়ে পদ্য লেখা ছাড়া,আর বেশী কিছু হয় বলে আমার মনে হয় না।
        সে'রকম লেখাই আজকাল অনেক চোখে পড়ে, যাতে প্রাণের সাড়া মেলে না।
মূর্তি গড়া হয় বটে,তা কখনই প্রতিমা হয়ে ওঠে না।
      কবিতা তো তাই যা সহজেই মানুষের চিত্ত চাঞ্চল্য ঘটায়,মনে করুণার উদ্রেক করে,নর নারীর বন্ধনকে মধুর করে,এবং হিস্র যোদ্ধার মনেও সান্ত্বনা এনে দেয়।
     মানুষ কাব্যে সান্ত্বনা খোঁজে, জীবনের দিকদর্শন চায়,আনন্দ খোঁজে এই নিরানন্দময় জীবনে।আমার তো মনে হয় তাই।নতুবা পাঠক অযথা কবিতা পড়তে যাবেন কেন,আজকের এই ইন্টারনেটের যুগে,যেখানে মানসিক উপভোগের সব রকম সামগ্রীই সহজলভ্য।
     বস্তুতঃ বহু শতাব্দী ধরে এ'কারণেই, কবিতা টিঁকে আছে আজও তার নিজস্ব সত্তা ও অস্তিত্ব নিয়ে,বহাল তবিয়তে।
          এ'ব্যাপারে পাঠকদের সুচিন্তিত মতামত প্রত্যাশা করি।

তিন.

কবিতা সরাসরি কথা বলে না।কবিতা লেখা হয় সান্ধ্যভাষায়,তাই বহুক্ষেত্রে
কবিতার ভাষা ইঙ্গিতবাহী, শঙ্খ ঘোষ যাকে বলেন, কবিতার অবগুন্ঠণ।
সে ইঙ্গিত সূক্ষ্ম হতে পারে, আবার স্থুলও হতে পারে।
স্থুল ইঙ্গিত কবিতার নিয়মিত পাঠকেরা সহজেই  ধরতে পারেন,বুঝতে পারেন।
  সূক্ষ্ম ইঙ্গিত সকলের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় বলে,সে'সব কবিতাগুলো দূরহ মনে হয়, তাদের কাছে।দুর্বোধ্যতা ভিন্ন ব্যাপার।
সূক্ষ অনুভূতিতন্ত্রের লোকেরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারে সে'সব লেখা,অবশ্য তাদের সংখ্যা খুবই কম।
           কবিতা ভাষা যেহেতু ইঙ্গিতবাহী সেকারণে - রূপক,চিত্রকল্প,উৎপ্রেক্ষণ,
নিপুন শব্দ ব্যাবহারের নিপুন দক্ষতা,সব কিছুই বিশেষ ভাবে ফুটে ওঠে কবির কবিতায়।
       অবশ্য কবিতা লেখার সময় এতসব ভেবে কবিতা লেখা হয় না।লেখা যায় না।
        কবিতা লেখার পূর্বেই এ'সব নির্দিষ্ট প্রক্রিয়াগুলে চলতে থাকে নিঃশব্দে, ভিতরে ভিতরে।এইসব প্রক্রিয়াগুলো,
মানসিক ভাবে কবিকে তৃপ্ত করলে,তবেই কবিতাটি ভূমিষ্ট হবার সুযোগ পায়।
     কবি তার প্রয়োজনে ছন্দকে ব্যবহার করেন তার কবিতায়,অবশ্য সর্বদাই সে ছন্দের অনুশাসন মেনে চলবেন  এমন কোন কথা নেই।কোথায়ও ছন্দের একচুল কম বেশী হলে, তিনি গায়ে মাখেন না।কবির মূখ্য লক্ষ্য থাকে কবিতাটির সুষ্ঠ বিন্যাস।তিনি মনে করেন,ছন্দ যদি পুরোপুরি কবিতাকে শাসন করে, তবে
অনেক সময়,কবিতার স্বতঃস্ফূর্ততা নষ্ট হয়।কবিতা খর্ব হয়ে পড়ার সম্ভবনা থেকেই যায়।
       অবশ্য ছান্দসিকের সেটা মনঃপূত
না হতেই পারে, তাতে কবির কিছু এসে যায় না।
         তারা ভুলে যান, কবিতার জন্যই ছন্দ,ছন্দের জন্য কবিতা নয়।ছন্দ কবিতার বাহন মাত্র,তার বেশী কিছু নয়।
ছন্দ মানুষকে বেশী মাতাতে পারে, তার একটা চুম্বক আকর্ষ আছে,যা যে কোন প্রাণীকেই অমোঘ ভাবে টানে। তাই
কবিতায় ছন্দ অপরিহার্য না হলেও কাঙ্খিত।কারণ, তাতে সহজেই মানুষের মনে দোলা দিয়ে,কবিতার ভাব সঞ্চারে সহজ সহায়তা করে।
     কবি জীবনানন্দ দাশ মনে করতেন,
  কোন কবিতা ছন্দে লেখা হবে, তা ভিতরে ভিতরেই ঠিক হয়ে যায়,কবিতাটি ভূমিষ্ট হবার পূর্বেই।
     প্রত্যেক মনীষারই এক বিশেষ ক্ষমতা থাকে,সে তার নিজের জগতে সিদ্ধ,কবির সিদ্ধিও তার কাব্য সৃষ্টির ভিতরে।অবশ্য তার মানে এই নয় যে কবি ব্যবহারিক জীবনে অকর্মণ্য,বরং সাধারণ বুদ্ধিমান লোকের মত,সে তার ব্যবহারিক প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম।
    কবিতা মূলত লোকশিক্ষা নয়,কিংবা তাকে রসসিক্ত করে পরিবেশন নয়,তাই যদি হতো তবে "সদ্ভাব শতক"  শ্রেষ্ট কাব্যের মর্যাদা পেত,তা কিন্তু পায়নি।
  স্লোগান কিংবা কোন বাণীও সেই অর্থে কবিতা নয়।তাহলে " সদ্ভাব-শতক"কে
সকলেই কাব্যগ্রন্থ ভাবত।কি তা কেউ ভাবে না।
        সামজিক পরিবর্তেন দায় কবির নিজের ঘাড়ে না নেওয়াই বাঞ্ছণীয়।তার জন্য সমাজপতিরা রয়েছেন। কবির কাজ মজাজপতিত্বের দায় কাঁধে তুলে নেওয়া নয়।অবশ্য তার মানে এই নয় যে তিনি সমাজের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কনবেন না। অবশ্যই করবেন,
তা তার নিজস্ব ভাষার পরিমন্ডলের মধ্যে, তা কখনও, সমাজপতিদের মতো উচ্চকিত স্লোগান ধর্মী হবে না।কবি কখনই অসামজিক মানুষ নয়,ফলে তার কবিতায় সামাজিক প্রতিচ্ছবি ফুঠতে বাধ্য,সৎ কিবি কখনই সমাজ ত্যাগ করে গজদন্ত মিনারে বাস করে কবিতা লেখেন না আজকাল।তিনি আর পাঁচ জন মানুষের মতো এই সমাজেরই একজন অধিবাসী।ফলে সমাজের ভালমন্দের দায় তার উপরও বর্তায়। তিনি সমাজের সঙ্কটময় মুহূর্তে নীরব থাকতে পারেন না।
  এই জন্যই বোধহয়,দার্শনিক এরিস্টটল কবিকে সমাজের সদা জাগ্রত প্রহরী বলে
অভিহিত করেছেন।
    অবশ্য তার গুরু সক্রেটিস ভাবতেন, সমাজে কবির কোন কাজ নেই,ফলে সমাজে তার কোন স্থান নেই।অসামাজিক মানুষ তিনি। কবি শঙ্খ ঘোষ যাকে শ্লেষ করে অনায়াসে বলেছেন,"মূর্খ বড়,সামাজিক নয়"।
        কবিতা পাঠ একটা একটা সতন্ত্র রসাস্বাদনের ব্যাপার।সে স্বাদ গ্রহনের জন্য পাঠকেরও প্রয়োজন হয় মনে মনে প্রস্তুতি গ্রহনের,নতুবা তার কাছে,  সে'রসের স্বাদ অধরাই থেকে যায় আজীবন।

চার.

 কবিতায় কবি কথা বলে।
                  কিন্তু কার সঙ্গে কথা বলে?
কবি মালার্মে কথিত, শুধু নিজের সঙ্গে?তাই যদি হবে, তবে কবি আর পাগলের বিশেষ তফাৎ থাকে না। একটা তফাৎ থাকে অবশ্য। পাগল নিজের সঙ্গে কথা বলেই তার কর্তব্য সম্পাদন করে। পাগলকে তা লিখে রাখতে হয় না।
      কবিকে তার কথা লিখে রাখতে হয়। কেন লিখে রাখতে হয় তবে?
             কাউকে শোনাবার জন্যই তো?
কিন্তু কেউ শুনবে কেন,তার আবোল তাবোল বলা কথাগুলো,যদি না তাতে পাঠকের মনে রস সঞ্চার হয়? যদি না তার অুনুভূতি তন্ত্রীতে আলোড়ন তোলে?
       তাহলে শেষ পর্যন্ত কথাটা দাঁড়াচ্ছে, কবি নিজের সঙ্গে কথা বললেও,সে চায় তার কথাগুলো পাঠকের দরবারে পৌঁছে দিতে।তাই সে কথাগুলো লিখে রাখে,ছাপতে দেয়।
     পাগলের সে সব কোন দায় থাকে না।
তবে কবিকে পাগল না বললেও বাতুল বলা চলে।
     কবি অনেক কথা বানিয়ে, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বেশী করে বলেন। আর তা করতে গিয়েই তাকে কবিতার ভাষার আশ্রয় নিতে হয়। আশ্রয় নিতে উপমা, চিত্রকল্প,ছন্দ, রূপক,উৎপ্রেক্ষণ,
ইঙ্গিতময় সান্ধ্যভাষার।
           আগেই বলেছি,কবিতার একটা নিজস্ব ভাষা আছে, সে ভাষা দীর্ঘদিন প্রচেষ্টায় রপ্ত করতে হয়। সে ভাষা
ইঙ্গিতময় এবং কথ্যরীতিতে বলা চলে,
   শঙ্খ ঘোষ যাকে বলেছেন,বাকছন্দ।
              কার কাছে কবিতা কি ভাবে আসবে,সেটা নির্ভর করে কবির ব্যক্তি সত্তার উপর।
তার মানসিকতা, রুচি,পাঠাভ্যাস,অধিত বিদ্যা,প্রিয় কবির প্রভাব,পারিপার্শিক পরিস্থিতি,সহযোগী সঙ্গ যাপন প্রভৃতি জটিল প্রক্রিয়ার উপর।
   একটা রহস্যময় ব্যাপার,য্ কোন কবিই বোধহয় পুরোপুরি ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে
পারেন না। কারণ তারা নিজেরাও বোঝেন না সবটা পুরোপুরি এই কুহেলিকার।
    কেউ কেউ, মালার্মের মতো মনে করেন, কবিতা শুধু কবির নিজস্ব অনুভূতির উন্মেষ,সেই কবিতা পাঠকের বোঝার ব্যাপারে,কবির কোন দায় নেই।
   এ'কথা শুনতে যতোই কাব্যিক মনে হোক, পুরোপুরি মানতে দ্বিধা হয়।
    পাঠকের প্রবেশের জন্য দরজা জানলা খোলা না থাকলে,পাঠকেরও কোন দায় থাকে না, সে বদ্ধ গুদামে প্রবেশের।
    কবিতায় কবি নিজের সঙ্গে যতই না কথা বলুক,তার একটা সংযোগ যদি পাঠকের সঙ্গে না ঘটে, তবে পাগলের প্রলাপ ছাড়া, তাকে আ র বেশী কিছু বলা চলে না। পাগলও নিজের সঙ্গে কথা বলে,কারও কোন দায় থাকে কি সে কথা শোনার?
   কবির লেখা যদি পাঠকরা পড়ে কিছুই না বুঝতে পারে,তবে তারা আগ্রহ বোধ করবে কেন কবিতা পাঠে? তবে সে লেখার সার্থকতা কোথায়?
   এই প্রসঙ্গে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের
সঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের পত্রালাপ মনে পড়ছে।
    কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত চাইতেন, পাঠকের অলস মনের জড়তা কাটাবার জন্য কবিতায় অপ্রচলিত শব্দের ব্যাবহার। তার যুক্তি ছিল, শব্দবাধায় ঠোক্কর খেয়ে, অনেকেই হয়তো ঘরে ফিরবে,কিন্তু তার পরেও যারা এগোবে,তারা অন্তত চলবে চোখ খুলে,কান মেলে প্রতি অগ্র পশ্চাৎ উর্ধ্ব অধঃ দেখতে দেখতে। এখানে অলঙ্কারের কথাও বলে নিই কেননা অলঙ্কার চিন্তাকে পরিস্ফূট করার বিশেষ সহায়। উপমানের সঙ্গে উপমার এত নিবিড় সম্পর্ক যে প্রথমটির স্বভাব অন্তত আংশিক ভাবে হলেও এসে পড়ে। কাজেই উপমার ভিতরেও একটা সামঞ্জস্য,একটা ন্যায় সঙ্গতি না থাকলে মুস্কিল।কিন্তু তাই বলে উপমাগুলিকে গতানুগতিক হতে হবে তার কোন মানে নেই, বরং উল্টোটাই ভালো।সত্যকে নতুন ভাবে দেখতে গিয়ে নূতন রূপকের দরকার হওয়া স্বাভাবিক।
    তিনি আরও বলেছেন, যারা কবিতাকে ছুটির সাথী বলে ভাবে,কবিতার প্রতি ছত্র পড়ে হৃদকম্পন অনুভব করতে চায়, তাদের কবিতা না পড়াই উচিৎ।কবিতার গঠন যেমন প্রত্যেক লাইন বিশ্লেষণ করে ধরা যায় না, তার ভাবাবেশও তেমনি খন্ডাকারে দেখা যায় না,বিরাজমান থাকে সমগ্রের মধ্যে।
    ভাব শুধু মেঘ বাঁশি প্রিয়া বিরহ মিলন
ইত্যাদি জরাজীর্ণ শব্দের করতলগত নয়,শুধু প্রেম বেদনা ও প্রকৃতিকে নিয়েই কাব্যের কারবার চলে না,তার লোলুপ হাত দর্শন- বিজ্ঞানের দিকেও আম্তে আম্তে প্র প্রসারিত হচ্ছে।
   এই " বিশেষ জ্ঞানে"র দিনে কাব্যের তরফ থেকে আমি পাঠকের কাছে,সেই নিবিষ্ট ভিক্ষা করি যেটা সাধারণ অর্পিত হয় অন্যান্য আর্টের প্রতি।
   বুদ্ধিমান অধ্যাবসায়ী পাঠকদের জন্য কবিতা লিখতেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত।
          রবীন্দ্রনাথের এ'মতে সায় ছিল না।
তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে জানিয়ে ছিলেন,
" মানুষের মধ্যে, যে লোকটা বুদ্ধিমান তার দাবীর দিকে না তাকিয়ে, যে লোকটা রসবিলাসী তাকে খুশি করার চেষ্টা কর।
বুদ্ধিমানদের জন্য আছেন আইনস্টাইন,
ব্রার্টান্ড রাসেল,প্রশান্ত মহালনবিশ,সুনীতি চাটুজ্জে মস্ত মস্ত লোক সব।"
           অথচ তিনি পাঠকরুচির কাছে আত্মসমর্পণের ঘোর বিরোধী ছিলেন।তাতে সস্তা সাহিত্যের আমদানী ঘটে এ'বোধ তার তীব্র ছিল।তার ভাষায়, "আদর্শ রক্ষা করতে গেলে প্রায়াসের দরকার,সাধনা না হলে চলে না।"
         কবি জীবনানন্দ দাশের কথায়,
" কাব্যে কল্পনার ভিতর,চিন্তা ও   অভিজ্ঞতার সারবত্তা থাকবে।"
     চিন্তা ও চেতনার কবির যেমন এক নিজস্ব জগৎ আছে।বাস্তব অভিজ্ঞতাও
তার চিন্তা চেতনাকে আলোড়িত করে, প্রভাবিত করে,এবং কবি তা প্রকাশ করেন,তার নিজস্ব কল্পনার মাধ্যমে।
এবং সে কল্পনাকে জাগরুক করতে হলে, তাকে আশ্রয় নিতে হয়,কখনও চিত্রকল্পের,কখনও রূপকের,কখনও উৎপ্রেক্ষণের,কখনও ছন্দ মাধুর্যের,কখনও ইঙ্গিতময় সান্ধ্যভাষার, কখনও যথার্থ শব্দ ব্যবহারের দক্ষতার।সব মিলিয়েই কবিতাটা রূপ পরিগ্রহন করে শেষ পর্যন্ত।
    এ'সব অনুভবের ব্যাপার,ব্যাখ্যা করে বোঝাতে গেলে,ভুল বোঝার সম্ভবনা থেকে যাবে, ঠিক মতো বোঝানো সম্ভব হবে না, হয় তো!
           কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেন,
" শব্দকে ব্রহ্ম বলা হয়।কবিতায় কথাই সব।কথায় কি না হয়? কবিতায় কথা মন্ত্রের মতো কাজ করে।কথার নড়চড় হলে কবিতা একদম দাঁড়ায় না।শব্দের মূল তত্ত্বের মধ্যেই নিহিত আছে কবিতার মূল কথা।কেননা,শব্দই হল কবিতার মূলাধার।"
বস্তুত,শব্দ বাছাইয়ের পার্থক্য থেকেই এক কবিকে অন্য কবির থেকে আলাদা করে চেনা যায়।মরা শব্দকেও ব্যবহারিক পারদর্শিতায় কবি জ্যান্ত করে তোলেন।
    যথার্থ কবির কাছে কথার খেলাই কবিতা হয়ে ওঠে, যা ম্যাজিক সৃষ্টি করতে পারে পাঠকের মননে।
        কথাটা যত সহজে বললাম আমি,
কাজটা মোটেই তত সহজ নয়, বরং কঠিন দূরহ ব্যাপার।তার জন্য প্রয়োজন হয়,রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, " কঠিন সাধনার"।
  অনেক সাধনার ফলে, সিদ্ধি লাভ করা সম্ভব হয়। মহৎ চালাকির সাথে ফাঁকি দিয়ে এই কাজ সম্ভব হয় না।

পাঁচ.

বিশেষ প্রকারের আনন্দ দেওয়াই কবিতার প্রধান কাজ।কবিতা পাঠের আনন্দ আর অন্য পাঁচ রকমের আনন্দ থেকে আলাদা,বুঝতে হবে।আর তা না হলে, সাধারণ আমোদ প্রমোদ বা কবিতা পড়ার আনন্দের মধ্যে কোন তফাৎ থাকে না।কবি ওয়ার্ডওয়ার্থ ও কোলরিজ কবিতা পাঠের আনন্দের মধ্য দিয়েই তার লক্ষণ বিচার করেছেন।তবে তারা কবিতা পাঠের আনন্দকে অন্যান্য আনন্দ থেকে আলাদা করে দেখাননি।ফলে,সমালোচনার হাত থেকে তারা রেহাই পাননি।
     টলস্টয়ের মতে,"কবিতার কাজ যদি শুধু আনন্দ দানই হয়,তবে তাকে নৈতিকতার দিক থেকে কোন গৌরবের বস্তু মনে হয় না।কিংবা ট্রাজেডি যে ধরণের আনন্দ আমাদের দেয়, তাকে তো সাধারণ অর্থে আনন্দ বলা যায় না। পরের দুঃখে আনন্দ পাওয়া কোন গৌরবের বস্তু নয়।"
     এই বিপর্যয় এড়াবার জন্য, গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল বললেন,ট্রাজেডিতে একধরণের বিশেষ আনন্দ আছে।কিন্তু সেই বিশেষ আনন্দ কি,তা আবার তিনি ব্যাখ্যা করেননি। দার্শনিক কান্টও,এই বিশেষ আনন্দের দ্বারা কাব্যর লক্ষণ বিচার করেছেন।সে আনন্দ-ইন্দ্রিয়জনিত সুখ,জ্ঞান ভিত্তিক কিংবা নীতি মূলক আনন্দ হতে পারে।সুতরাং কবিতা আমরা পড়ি,তা থেকে বিশেষ ধরণের আনন্দ পাই বলেই। কবি লংগাহনাস,কবিতা পাঠে,
"তূরীয় আনন্দের"কথা বলেছেন।আলংকারিক অভিনবগুপ্ত এই আনন্দকে
' অলৌকিক চমৎকার ' বলেছেন।অন্য ভারতীয় আলংকারিকরা এই আনন্দকে,
'ব্রহ্ম স্বাদ সহোদরা' আখ্যা দিয়েছেন।এর দ্বারা মনন তৃপ্ত হয়।
    আর এই অলৌকিক আনন্দ সৃষ্টি করেন কবিরা,ভাষার মাধ্যমে। এই জন্যই বোধহয় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবিদের বলেছেন "ভাষার যাদুকর"।
     কবি কবিতায় শুধু শব্দের অর্থ জ্ঞাপনের কাজটি করে সন্তষ্ট হতে পারেন না,তিনি শব্দের ধ্বনির সাহায্য নেন তার ভাব প্রকাশের জন্য,কবিতায় চমৎকারিত্ব সৃষ্টির জন্য।
    এ তো গেল, কবিতায় আনন্দ দানের দিকটির কথা।
   অন্যদিকে,কবি কীটস কবিকে 'সত্য ও সুন্দরের ' পূজারী বলে আখ্যা দিয়েছেন।ররীন্দনাথেরও এ'মতে সায় ছিল।
গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল কবিকে বলেছেন "সমাজের জাগ্রত প্রহরী"। অথচ তার গুরু সক্রেটিস বলেছেন,সমাজে কবির কোন ভূমিকাই নেই।সে সমাজে অপাংতেয়।সমাজে তার কোন দরকার নেই।সমাজ থেকে তাকে বহিষ্কার করা উচিৎ।
   অথচ ভারতীয় ঋষিরা কবিকে এমন উচ্চ মর্যাদায় স্থান দিয়েছিলেন যে তারা মনে করতেন," কবিতা পাঠে ঈশ্বর প্রাপ্তির স্বাদ অনুভব যায়।"
   কবিতা পাঠে সত্য ও সৌন্দর্যের উপলব্ধিতে, যে আনন্দ পাওয়া যায় সে আনন্দ বিশেষ ধরণের আনন্দ ,সাধারণ বা লৌকিক আনন্দ থেকে তা পৃথক,তা হল জ্ঞান উপলব্ধির আনন্দ।
   ফরাসী কবি মালার্মে বলেছেন,কবি নিজের সাথে কথা বলে,আমরা পাঠকরা তা আড়ি পেতে শুনে,মজা বা আনন্দ পাই, আর তাই বলেই তা শুনি।কবির কাজ নয় তা শোনানো।
কবি জীবনানন্দ দাশ মনে করতেন,কবিরা যখন ভাবাক্রান্ত হন তখন কবিতা লেখেন, আবার কবি বিষ্ণু দে বলেন,'সংবাদ মূলত কাব্য'।
  ধ্বনিকার আনন্দবর্ধন মনে করেন, কবিতায় শব্দ এমন ভাবে ব্যবহার করা হয় যে তাদের বাচ্যার্থের মধ্য দিয়ে এবং তাকে ছাড়িয়ে একটি ব্যঞ্জনার্থ প্রকাশিত হয়,যা কাব্যের প্রধান অর্থ হয়ে চিত্তকে দোলা দেয়,একটা চমৎকারিতার আস্বাদ দেয়।শরীরের লাবণ্য যেমন,শরীরের ভিতরেই প্রকাশিত হয়েও তা শরীর অতিক্রম করে একটি সতন্ত্রভাব বস্তু রূপে প্রতিভাত হয়,কাব্যের ধ্বনি সেই ভাবেই কবিতায় উপস্থিত হয়।ভাবকে রসে উন্নীত
করতে হলে, শব্দের বাচ্যার্থের চেয়ে,
তাদের ব্যাঞ্জনার্থের বেশি সাহায্য নিতে হয় তবুও এই রসই সেই কাব্যানন্দের স্বরূপ।
  এত সব বিবেচনা করে অবশ্য কোন পাঠকই কবিতা পড়েন না।যারা কবিতা পড়েন তারা কবিতা পড়ে কিছু পান বলেই কবিতা পড়ে থাকেন বলে আমার মনেহয়।


প্রবন্ধ: সিদ্ধার্থ সিংহ



                                    বসন্ত মানেই দোল
                                          সিদ্ধার্থ সিংহ


শ্রীকৃষ্ণ তখন একেবারেই বালক।  সারা গোকুল তার দুষ্টুমিতে অস্থির। গোপিনীরা মাথায় হাঁড়ি করে ননি নিয়ে হাটে যেতে ভয় পায়, কখন দলবল নিয়ে সে হামলা চালায়! তবু সকলের কাছেই সে ছিল নয়নের মণি।
কিন্তু অন্যান্যদের তুলনায় গায়ের রং একটু চাপা হওয়ায় তার মনে নিশ্চয়ই একটা কষ্ট ছিল। তাই একদিন সে তার পালিকা মাকে বলেই ফেলল, মা,  রাধা-সহ সব গোপিনীরাই এত ফরসা, কিন্তু আমার রং কালো কেন?
এ কথা শুনে মা যশোদা ঘর থেকে কিছুটা আবির এনে তার সারা গায়ে মাখিয়ে দিলেন এবং বললেন, যাও, এই আবির সবাইকে মাখিয়ে দাও। তা হলে কেউ আর কালো বা ফরসা থাকবে না। সবাই সমান হয়ে যাবে।
মায়ের কথা শুনে সে সঙ্গে সঙ্গে ছুটল গোপিনীদের আবির মাখাতে। ব্যাস, সবাই মজা পেয়ে গেল। আর সেই যে শুরু হল,  তার পর থেকে সেই দিনটাই চিহ্নিত হয়ে গেল সবাই সবাইকে আবির মাখানোর দিন হিসেবে। আর সেই জায়গাটাও নির্দিষ্ট নির্দিষ্ট হয়ে গেল দোলমঞ্চ হিসেবে। যত দিন গেল গ্রামে গ্রামে গজিয়ে উঠতে লাগল নতুন নতুন দোলমঞ্চ। যেহেতু সেই দিনটা ছিল পূর্ণিমা, তাই সবার কাছে সেটা হয়ে গেল দোল পূর্ণিমা। মানে ফাল্গুনি দোল পূর্ণিমা।
শুধু এ দেশেই নয়, এশিয়া মহাদেশের নেপাল, দক্ষিণ আমেরিকার সুরিনাম,  উত্তর আমেরিকার ত্রিনিদাদ ও  টোবাগো, ওশেনিয়া অঞ্চলের ফিজি, আফ্রিকা মহাদেশের মরিশাস ছাড়াও যেখানেই ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা আছেন,  সেখানেই জাঁকজমক করে প্রতি বছর পালন করা হয় দোল উৎসব। দক্ষিণ আমেরিকার গায়ানাতে তো দোলটা  আবার রীতিমত জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের সময়ে দোল অন্য মাত্রা পায়।  নাচ,  গান, আবৃত্তি,  নাটক এই উৎসবের অঙ্গ হয়ে ওঠে। আজও প্রতি বছর দোলের দিন সকালবেলায় প্রভাতফেরি বের করে আশ্রমিকেরা। তারা দল বেঁধে--- ‘ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল লাগল যে দোল' গানটি গেয়ে বসন্তোৎসবের সূচনা করে। সন্ধ্যাবেলায় গৌরপ্রাঙ্গণে কবিগুরুর কোনও না কোনও নাটক মঞ্চস্থ হয়।তা দেখতে শুধু এ দেশের নানা কোণ থেকেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এসে ভিড় করে।
চোদ্দোশো এক সালে বাংলাদেশেও রঙের উৎসব শুরু হয়। সেই থেকে আজও ‘জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ’ প্রত্যেক বছর খুব ঘটা করেই আয়োজন করে এটা।  যদিও এখন তার আঁচ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের অন্যত্রও।
এক সময় শুধু আবিরই ব্যবহার করা হত। বলা হত,  আবির গায়ে মাখলে নাকি বসন্ত রোগের প্রকোপ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। কিন্তু যত দিন গড়িয়েছে,  মানুষ ততই আবিরের বদলে ব্যবহার করতে শুরু করেছে বালতিতে গোলা রঙিন জল। ব্যবহার করা শুরু করেছে পিচকারি। যাতে কেউ রং দেখে ছুটে পালাতে গেলেও দূর থেকেই তাকে রাঙিয়ে দেওয়া যায়। যিনি রং মাখতে চান না,  তাকে জোর করে রং মাখানোর আনন্দই যেন আলাদা। পাড়াতুতো দেওর বউদিদের খুনসুটি মাখানো রং খেলা তো সর্বজনবিদিত। স্কুল কলেজ বন্ধ থাকে বলে আগের দিনই রংচং নিয়ে  ভূত সাজে ছাত্রছাত্রীরা। প্রচুর প্রেমের সূত্রপাতও হয় এই দিন।
তারও পরে রঙের পাশাপাশি দোলের অঙ্গ হয়ে ওঠে পঁচা ডিম, মোমের ফুচকা, মোবিল, এমনকী কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি অত্যন্ত বিপজ্জনক নানান রংও। যা হাজার চেষ্টা করেও এক-দু’দিনে ওঠানো তো দূরের কথা, এক সপ্তাহ পরে তোলাও প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। শুধু তা-ই নয়, ওই রং যে চামড়ার পক্ষে  খুবই ক্ষতিকারক, তা ব্যবহারকারীরাও জানেন। তবু ব্যবহার করেন। শোনা যায়,  ওই রঙের জন্য কারও কারও চোখও নাকি নষ্ট হয়ে গেছে।
শহরের বাইরের ছবিটা অতটা ক্ষতিকারক না হলেও বেশ কদর্য। কাছাকাছি ডোবা না থাকলে শুধুমাত্র দোলের জন্যই রাতারাতি ছোট ছোট ডোবার মতো গর্ত করে তাতে আগে থেকেই গোবর জল গুলে রাখা হয়। লোকজনকে কোলপাঁজা করে তুলে এনে সেখানে ফেলে নাকানি চোবানি খাওয়ানোর মজাই নাকি আলাদা। কোথাও আবার বালতি করে নোংরা জল লুকিয়ে লুকিয়ে এনে পেছন দিক থেকে আচমকা কারও মাথায় ঢেলে দেয়।
আর এই রং দেওয়ার অজুহাতে কিছু ছেলেপুলে কোনও কোনও মেয়ের সঙ্গে যে অশালীন ব্যবহার করে না, তাও নয়। আর তা নিয়ে দোলের দিন পাড়ায় পাড়ায় গণ্ডগোলও কম হয় না। সেই রেশ থেকে যায় বেশ কয়েক দিন।
তার ওপরে, এই দিনে বেশ কিছু উঠতি ছেলেমেয়েদের মধ্যে মদ খাওয়ার প্রতি একটা প্রবল প্রবণতা দেখা যায়। তাই প্রশাসনের তরফ থেকে বারবার আগাম সতর্কবার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়। রাস্তায় রাস্তায় টহল দেয় সাদা পোশাকের পুলিশ। ধরপাকড় চালায় একই বাইকে তিন-চার জন মিলে হুল্লোড় করতে করতে যাওয়া উৎশৃঙ্খল বাইক আরোহীদের। ফলে এক সময় যা ছিল নিখাদ আনন্দের, রং মাখানোর পরে মিষ্টিমুখ করানোর সামাজিক রীতি, আস্তে আস্তে তা উধাও হয়ে যায়।
দোল আসলে হিন্দু সভ্যতার প্রাচীন উৎসব। তাই নারদ পুরাণ, ভবিষ্য পূরাণ ও জৈমিনি মীমাংশা’তেও রঙের উৎসবের বিবরণ পাওয়া যায়।  তিনশো খ্রিস্টপূর্বাব্দের এক শিলালিপিতেও রাজা হর্ষবর্ধনের ‘হোলিকোৎসব’ পালনের উল্লেখ দেখতে পাই।
অনেকেই এই দোলের সঙ্গে ‘হোলি’কে গুলিয়ে ফেলেন। আসলে হোলি আর দোল কিন্তু এক নয়। সম্পূর্ণ আলাদা।
স্কন্দ পুরাণ থেকে জানা যায়, দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর ভাই হিরণ্যাকের মৃত্যু হয় বিষ্ণুর হাতে। তখন ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য শোকে মুহ্যমান হিরণ্যকশিপু কঠোর তপস্যায় বসেন। তাঁর সাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা তাঁকে বর দেন---  না জলে,  না স্থলে,  না ঘরে,  না বাইরে,  না রাতে, না দিনে, না আকাশে, না মাটিতে, না অস্ত্রে,  না শাস্ত্রে--- কোথাও, কোনও কিছুতেই তাঁর মৃত্যু হবে না।  শুধু তা-ই নয়, নাগ, অসুর, দানব, গন্ধর্ব, দেবতা, পশু, মানুষ, যক্ষ, রক্ষ, কিন্নর,  দিকপাল,  লোকপাল,  প্রজাপতি--- এক কথায় ব্রহ্মার যত সৃষ্টি আছে, তারা কেউই তাঁকে হত্যা করতে পারবে না।
এই বরে হিরণ্যকশিপু এতটাই ঔদ্ধত্য হয়ে উঠেছিলেন যে, ক্রমশ দেবতাদেরই তিনি অবজ্ঞা করতে শুরু করেন। বিশেষ করে বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন বিষ্ণুর। কারণ, এই বিষ্ণুর হাতেই বধ হয়েছিল তাঁর ভাই।
তাঁর ছেলে প্রহ্লাদ যেহেতু বেশ কিছু দিন নারদের হেফাজতে ছিল, তাই সে হয়ে উঠেছিল পরম বিষ্ণুভক্ত। সে এতটাই ভক্ত হয়ে উঠেছিল যে,  সে জন্য তার নামের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল ‘ভক্ত’ শব্দটা। তাই প্রহ্লাদ থেকে সে সবার কাছে হয়ে উঠেছিল--- ভক্ত প্রহ্লাদ।
তাঁর চরম শত্রু বিষ্ণুর  প্রতি ছেলের এই পরম ভক্তি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না হিরণ্যকশিপু। তাই সেই ভক্তি দূর করার জন্য  ছেলেকে তিনি নানা ভাবে বোঝাতে লাগলেন। লোভ দেখাতে লাগলেন। কিন্তু তাতেও কোনও ফল না হওয়ায় তাকে জব্দ করার জন্য তিনি নানা রকম শাস্তি দিতে লাগলেন। কিন্তু তাতেও ছেলের কোনও হেলদোল না দেখে তিনি শেষ পর্যন্ত কঠিন কঠোরতম পথই বেছে নিতে বাধ্য হলেন। স্থির করলেন তার মৃত্যুদণ্ড।
কখনও ক্রুব্ধ দৈত্যরাজ মশানে গিয়ে প্রহ্লাদের ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা করার হুকুম দিলেন। কখনও বদ্ধঘরে বিষধর  সাপ ছেড়ে দিতে বললেন।  কখনও পাগলা হাতির পায়ের সামনে তাকে ছুড়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন। কখনও আবার হাত-পা বেঁধে গলায় বিশাল বড় পাথরের চাঁই বেঁধে অতল সমুদ্রে ফেলে দিতে বললেন। আর প্রতিবারই একের পর এক নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসতে লাগল ভক্ত প্রহ্লাদ।
তখন একেবারে তিতিবিরক্ত হয়ে হিরণ্যকশিপু স্মরণাপন্ন হলেন তাঁর বোনের। তাঁর বোন ছিলেন হলিকা রাক্ষুসি। তিনি তপস্যা করে দেবতাদের কাছ থেকে বর পেয়েছিলেন, আগুন তাঁকে কখনও পোড়াতে পারবে না। তাই হিরণ্যকশিপু তাঁকে পরামর্শ দেন, তাঁর ছেলেকে নিয়ে জলন্ত আগুনে প্রবেশ করার জন্য। যাতে তাঁর ছেলে আগুনে পুড়ে খাক হয়ে যায়।
হিরণ্যকশিপুর নির্দেশে তাঁর লোকজনেরা প্রচুর কাঠকুঠো স্তূপীকৃত করে তাতে আগুন ধরিয়ে দিলেন। আগুন দাউদাউ করে জ্বলতেই দাদার কথা মতো ভক্ত প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে তিনি সেই আগুনের মধ্যে প্রবেশ করলেন।আগুনে ঢোকার সময় তাঁর স্মরণেই ছিল না,  দেবতারা তাঁকে বর দেওয়ার সময় একটা শর্তও চাপিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন,  তুমি যদি কখনও এটাকে অপব্যবহার করো, তা হলে এই বরের যাবতীয় গুণ নষ্ট হয়ে যাবে এবং  আগুন তোমাকে গ্রাস করবে।
যেহেতু একটা নিরাপরাধ নিষ্পাপ শিশুকে পুড়িয়ে মারার জন্য উনি আগুনে প্রবেশ করেছিলেন,  সেই অপরাধে  তাঁর সেই ‘বর' -এর গুণ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে যা হবার তা-ই হল।
হলিকা রাক্ষুসি আগুনের ভিতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে গেলেন। আর সেই আগুন থেকে হরিনাম করতে করতে একদম অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে এল একরত্তি বালক--- ভক্ত প্রহ্লাদ।
সেই থেকেই অশুভশক্তির বিরুদ্ধে শুভশক্তির জয়ের দিন হিসেবে হলিকাদহন পালন করা হয়। হলিকা রাক্ষুসির নামেই। পরে ধীরে ধীরে অপভ্রংশ হয়ে লোকের মুখে মুখে সেটাই হয়ে যায় হলিকা দহন থেকে শুধু--- ‘হোলি'। কেউ কেউ অবশ্য ‘হোরি’ও বলে।  সমস্ত ‘অপ’কে পুড়িয়ে শুদ্ধিকরণ করাই হল  এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্য। তাই দোলের আগের রাত্রে খড়কুটো জড়ো করে আগুন লাগানো হয়। এটাকে কোথাও বলা হয় চাঁচড়,  কোথাও নেড়া পোড়া। কিন্তু না, এখন আর কাউকেই বলতে শুনি না এর আর একটা কঠিন নাম--- ‘বহ্র্যুৎসব’।
যদিও এই দুই উৎসবের সঙ্গেই ওতপ্রোত ভাবে জড়িত এই নেড়া পোড়া বা চাঁচর পোড়ার অন্য আর একটা আধুনিক ব্যাখ্যাও রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, দোল বা হোলি যেহেতু ঋতুচক্রের শেষ উৎসব, তাই উৎসবের আগেই গাছপালা থেকে ঝরে পড়া ডালপাতা, জীর্ণ, ভাঙাচোরা, পুরনো জিনিসপত্র, যেখানে যা আছে, সব এক জায়গায় জড়ো করে পোড়ানোর উদ্দেশ্যই হল চারিদিক একেবারে সাফসুতরো করা। আবার নতুন ভাবে  জীবন শুরু করা।এই নতুন ভাবে জীবন শুরু করাই হল নেড়া পোড়ার আসল লক্ষ্য।
লক্ষ্য যাই হোক, আমরা কিন্তু এই দোলকে রঙের উৎসব হিসেবেই বেছে নিয়েছি। কিন্তু রং যাতে আমাদের কোনও ক্ষতি করতে না পারে, সে জন্য আবির তৈরির আদিম ঘরানাকেই ফিরিয়ে আনার তোড়জোড় চলছে বহু দিন ধরেই। ছোটখাটো বিভিন্ন সংস্থা হার্বাল আবির বানাতে শুরু করে দিয়েছে।  বিভিন্ন ফুলের পাঁপড়িকে বিশেষ পদ্ধতিতে গুঁড়ো করা হচ্ছে। তার পর তাতে নানান ফুলের নির্যাস মিশিয়ে একেবারে হান্ড্রেড পারসেন্ট নির্ভেজাল এবং নিরাপদ আবির বানানো হচ্ছে। সে জন্য তাদের উদ্যোগকে বাহবা দিতেই হয়।  কিন্তু কথা হচ্ছে, সেগুলো বানাতে গিয়ে এতটাই ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে যাচ্ছে যে, সেটা আর সাধারণ লোকের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকছে না। ফলে উদ্যোগ ভাল হলেও তা মুখ থুবড়ে পড়ছে।
তবু বলব, দিনের শেষে আমাদের মনে যতই কালিমা থাকুক, যতই কষ্ট থাকুক, বছরের অন্তত এই একটা দিন রঙের ছোঁয়া পেয়ে, সব দুঃক্ষকষ্টকে দূরে সরিয়ে আমরা কিন্তু রঙিন হয়ে উঠি। অন্তত রঙিন হয়ে ওঠার চেষ্টা করি।  এখানেই দোলের সার্থকতা। হোলির পরিপূর্ণতা। বসন্তের শ্রেষ্ঠ উৎসব।

সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২০


   অণুকবিতা
      
        অনুশ্রীতা বিশ্বাস,ঋভু চট্টোপাধ্যায়, 
      বিশ্বজিৎ হালদার, ডঃ রমলা মুখার্জী,
      রীতা রায়,সোমাধর ঘোষ, বদরুদ্দোজা        শেখু,পিয়ালী গোস্বামী, ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায়,
   আব্দুস সালাম,প্রতিমা ভট্টাচার্য্য মন্ডল,
              বর্ণালী দত্ত,অরিন্দম মাইতি

                        অণুগল্প

             ‌  রাণা চ্যাটার্জী, মহুয়া মিত্র, 
           আনন্দময়ী মুখোপাধ্যায়

কবিতা :ঋভু চট্টোপাধ্যায়


                       না  বলা অথবা  
                       ঋভু চট্টোপাধ্যায়

               এভাবে বুকের অগুন জ্বালাতে পারিস
              যেভাবে তুলি ক্যানভাস জুড়ে থাকে
              একটা গহিন বন্য নদীর ধারে
             যেভাবে হাজার স্বপ্ন ধরে রাখে।
             এভাবে কেউ পাগল হতে পারে
             যেভাবে মেঘ আকাশকে রাখে ফন্দি
             কাউকে ছুঁয়ে যাযাবর হতে পারি
          আমিও তো সেই উদাসীন স্রোতে বন্দি।

কবিতা: অনুশ্রীতা বিশ্বাস


             আলোহীন জানালার ধারে
                     অনুশ্রীতা বিশ্বাস

           আলোহীন  জানালার  ধারে
                      পথিকের  পায়ের  শব্দে,
          মনের  তীব্র  আবেগে দমিত
                     দহন হৃদয়সংকূলে -
                   শীতল বায়ুর স্পর্শে
          দমিত  আবেগে  স্পর্শ  এনেছে,
                  পথিকের  পথ চেয়ে
               আবারও  প্রদীপ জেলেছে। 

শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২০


হাতটা ধরিস 
                                                      বিশ্বজিৎ হালদার

স্মৃতির ব্যালকনি থেকে, পুরনো পৃথিবীটা দেখছি-
কৃষ্ণচূড়ার বর্ষা ভেজা বকুলের ঘ্রাণে ,না


সুবাসে আমার অলিন্দ।
পড়ন্ত বিকেল বেলা, আচমকা ঘুম ভাঙ্গে ইরাবতীর ডাকে। 
সময়ের কোন বাঁধন নেই , তোর আবদারে,
মাঝে মাঝে সখের যাযাবর হয়ে ওঠা।
হাজার দুঃখের মধ্যে আজও খুঁজি, ডাইরির প্রতিটি অক্ষরে, 
একদুয়ারে নাইবা হলাম অতিথি সুযোগ পেলে হাতটা ধরিস।



                         রোদের জন্য
                       ডঃ রমলা মুখার্জী

রোদ্দুর হয়ে এসেছিলে জীবনে
কিন্তু অভিমানের কাল মেঘ তোমাকে গ্রাস করল।
একদিন অবিশ্রান্ত বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে বাড়ি এসে দেখি তুমি নেই।
সুইসাইড নোটে লেখা,"কারও ওপর কোনো রাগ নেই আমার "।
ঝলমলে রোদকে তো কখনও আপ্যায়ন করিনি।
অনাদরে, অবহেলায় সোনালী ম্লান হয়েছে ক্রমশ....
অপমানের আঁধার বুকে সে আজ আলোর উৎস সন্ধানে....
মুখ থুবড়ে আমার বর্তমান।

                  ভালোবাসা চিরন্তন  
                                       রীতা রায় 

             সুখের ভাগ দাওনি কখনো 
             দুঃখেও রাখোনি সাথে ..
             ছিলাম শুধু তোমার একাকীত্বে,
            সেখানেও উপেক্ষিত জানি..
            তবু, নিঃস্বতা আঁকড়ে থাকে 
            থেমে যাওয়া পেণ্ডুলামে !
            ভালোটুকু বাসি হয়ে গুমরে মরে
            অন্তরের ঘুপচি ঘরে !

                             মাঝে

                                 সোমা ধর ঘোষ


তোমার চোখের অপরাহ্ন
     আমার আর বসন্তদিনের মাঝের
          দরজাটা খুলে দিয়েছিল

             আমি দেখেছিলাম কৃষ্ণচূড়া


 আজও আমার প্রেমের ছায়াপথে হাঁটো
       বলো গোপন---চুপকথা।

সময়-সাম্পানে ভেসে
   পাগলপারা দুটি হলুদপাখি 
       কাকলি ভুলে উদযাপন
           করে মৌনতা।

                        আষ্টেপৃষ্ঠে
                          বদরুদ্দোজা শেখু

আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছি তার সাথে যেন লিপস্টিক
স্নো-পাউডার আলতা সিঁদুর কাঁচের চুড়ি জরির টিপ
পরীর ছোঁয়া চোলির ছোঁয়া গোয়া মুম্বাই
সায়া শেমিজ
সব কিছুতে মাখামাখি প্রেম পীরিতি বেত্তমিজ,
হিজ-এন-হার একাক্কার কোরা কাগজে অঙ্গুঠায়, ----
সাদা হৃদয় ধার ধারে কি ভাব হিসাবের জগৎটায় ?
জড়িয়ে গেছি আষ্টেপৃষ্ঠে আপাতদৃষ্টে উদাহরণ
লুকিয়ে আছে ফুলের মধ্যে ভুলের লজ্জা লহু-ক্ষরণ ।।

                        স্মৃতিটুকুই থাক                                                 পিয়ালী গোস্বামী

             ভাসমান স্রোতে সবাই ভাসছে,
             ভাসছিল অনুভূতিগুলোও
            শুধুই হতাশা।
            জানো?আপন পরের হিসাবটা?
            সবাই আবেগতারিত
            হিসাবটা অজানা।
           সিগারেটের টানে বড্ড মাথা ধরে,
           প্রতারনার দায় পাহাড়ের নেই
           সে জানেও না যে, সে মারা গেছে।।

                       বৃষ্টি ভেজা রাত

                                     রাণা চ্যাটার্জী



"অঝোর ধারায় বৃষ্টি!
একি কান্ড তাবলে এভাবে ভিজবি!?"

ডুবল রাস্তা।সামনে পরীক্ষা এদিকে  লোডশেডিংয়ের বহর ! দূর ছাই এভাবে পড়াশোনা হয়-আক্ষেপ।

এলো লাইট, বাজছে মধ্যরাত্রির ঢং ঢং ঘন্টা।
 থৈ থৈ পুকুর,ব্যাঙের ডাক,অদ্ভুত মাদকতার ব্যালকনি, ল্যাম্পে ঘনীভূত বাষ্প।

খস খস শব্দ !ওরে বাবা এ কি!টর্চ জ্বালিয়ে দেখি,পরিত্যক্ত ঝুপড়িতে কে যেন সেঁধিয়ে!

"এই ওঠ, আয় বারান্দায়,নির্ঘাত নিউমোনিয়া!"
ঘুম ভাঙতেই ভোরে এক দৌড়ে নিচে।কি করছে ছেলেটা একবার দেখে আসি বলে গিয়েই থমকে।

এ কি !তালাবন্ধ বারান্দা ! স্বপ্ন ছিল?
অসহায় মানুষের কত কষ্ট ,আমরা চোখ থাকতেও আত্মসুখী

                         প্রেমের  ছোঁয়া

                    ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায়


         প্রেমের নেই কোন সময় অসময়,
         সবেতেই বাঁধা তার নিশ্চিত জয়।
        মানেনা কোন সে জাত পাত,
        বয়সের পার্থক্যে নেই তার হাত ।
   বিভাজন নেই তার সচ্ছল,অসচ্ছলতার,
        রূপ দেখে কখনই করেনা বিচার।
       চাই তার দুটি হৃদয়ের সংযোগ,
       প্রেমে বুঁদ হয়ে করুক উপভোগ ।
       প্রেম ছাড়া জীবন বড় অর্থহীন,
       এর ছোঁয়া পায় যে, দুচোখ স্বপ্নে                 রঙিন।

                               সুধা সঙ্গ

                                   আবদুস সালাম 

   যুবতি দেহে খেলা করে অজস্র সাহিত্য
   কামাতুর পুরুষ গন্ধ পায় উচ্ছ্বাসের
  বালিকা দেহে ঝুলে আছে রমনসুধাআদর

  ভ্রষ্টতা ভেসে যায় চুম্বনের স্রোতে
  ক্রমশ ডুবে যায় যুবতি শরীরে
  ভেঙে যায় বাঁধ

  আবদ্ধ হয় প্রশান্তির বাহুমুলোই
  শরীরের সামিয়ানায়  টাঙানো উথাল পাথাল        আদর

   একটা ইতিহাস হবে বলে বার বার  নির্মান
   ভাঙি ।


                অবশেষে প্রেম আসে

                        বর্ণালী দত্ত

  
প্রেম হোক।
দুরের ঘরের অন্ধ জানালায় -আলো পরুক।
বেদনাচিহ্নিত এই কুটিররেও কেউ ভালোবাসুক।
দুচোখের নেশায় এখন বিষ, 
প্রেম আসে, তা চরনে দান করা হয়না।
শুধু  জ্যোৎস্নার নিভে আসা আলোয়-
এগিয়ে এসে মিশে যায় শরীর, 
মৃদু কাপড়ের আবরন নেশাতে অদৃশ্য হয়ে-
তৃষ্ণার্ত ঠোঁট মিলে যায়। 
ক্রমে বিছানার মায়াজাল তোলপার করে দুটি দেহ।
আলিঙ্গন দিয়ে শুরু :আবার আলিঙ্গনেই শেষ।।


                                অন্ধকার

                   প্রতিমা ভট্টাচার্য্য মন্ডল


                  নিশুতি শব্দহীন রাতে
                 একলা জেগে থাকি ।
                 বিশ্বচ‍রাচর মনে হয়
                 অতল গভীর ঘুমে মগ্ন।
                 কোথাও একটু শব্দ হলে,
                 মনের মাঝে ভয় দানা বাধে।
                 কি জানি কিসের ভয়,
                অন্ধকারের অজানা রহস্য
                ভেদকরা যায় না তা ।
                তবুও আমরা ভয় পায়,
                ব‍্যাখ‍্যাহীন অজানা ভয়।
               রাতের অন্ধকারে একলা ঘরে
               মন যে কতকথা বলে,
               নিজের সাথেই নিজে।
               তখন মনে হয়, 
              আমি আর আমার মন
              যেন অন্তরঙ্গ দুই বন্ধু।
              দুজনের দুই শত্তা ,
              মিলে মিশে এক হয়।

                 কল্পনাদের আঁকড়ে রাখা ক্ষত

                                অরিন্দম মাইতি


                  কল্পনাদের আঁকড়ে রাখা ক্ষত
            অপেক্ষাদের প্রহর গোনা রোজ,
           গুগল ম্যাপেও থাকছে বুঝি ভুল
           অন্তমিলেই পথ হারানোর খোঁজ।

           আমি এখন অনেক রাত্রি জাগি
  সঙ্গী আমার ইনসোমনিয়া,ব্ল্যাক কফির কাপ,
            তুমি এখন ঘুমোও  বরং 
            তোমার পাড়ায় এখন অনেক রাত।।





                   এখনো বকুল ফোটে

              আনন্দময়ী মুখোপাধ্যায়


    মনে আছে স্বপ্নময়, আমাদের সেই সুগন্ধি
বকুলঝরা বসন্ত-গ্রীষ্মের দুপুর বিকেলের দিনগুলো। আমি বলতাম বকুল শুকিয়ে যায় তবু সুগন্ধটি
থাকে। তুমি বলতে আমরা শ্রীহীন হব আমাদের ভালোবাসা টি খুশবুদার থাকবে বার্ধক্যে।
     'দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না'----
   সবইচ্ছে পূরণ হতে নেই কি!
   ‌ প্রেমেরজোয়ারে ভাসিয়ে আমায় অপেক্ষায় রেখে প্রবাসে গেলে তোমার উচ্চতর প্রত্যাশা পূর্ণ করতে,
প্রবাসে প্রতিষ্ঠার শিখরে নজর দিতে আমাকে ভুললে, পথ বদলালে। অন্যগামী। স্নিগ্ধবকুলগন্ধে
মন বসেনা। তীব্রগন্ধ চাই।
     ----আর নয়। আমার একলা পথচলার ভাবনা।
সন্ধান পেলাম শান্ত নতুন জগতের। নগরীর কোলাহল এড়িয়ে দূরগায়ের স্কুলের শিক্ষয়িত্রী আমি।
    পেয়েছি অন্যভালবাসার জগৎ, এখানে ‌বকুল
ফোটে। শিশুদের ভালোবাসার সুগন্ধে চিরনতুন,
বর্ষে বর্ষে নতুনশিশুর দল।

                                     সত্যি ভালোবাসা

                             মহুয়া মৈত্র


" আজ আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী । তাই আমি আজ তোমাকে সাজিয়ে দেব আমার মনের মত করে । এই যে, খোঁপায় দিলাম জুঁইয়ের মালা, কপালে লাল টিপ, কানে সোনার ঝুমকো, গলায় সোনার হার, হাত ভর্তি চুড়ি , লাল বেনারসী আর অবশ্যই সিঁথি ভরে সিঁদূর । ঐ দ্যাখো, আয়নাও বুঝি তোমায় দেখে লজ্জা পাচ্ছে । "

চোখের জল ফেলে স্বামী ঘরের বাইরে চলে গেল । আয়নার সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে স্ত্রী, গতমাসে কঠিন চোখের অসুখ ধরা পড়ে আজ সে পুরোপুরি অন্ধ ।


মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০২০



                                     ব্যাকওয়ার্ড
                                       সহেলি দেব
                 একতারাতে তুষ্ট হওয়া বরফ পুষ্ট নদীর
                 সন্ধ্যা আবেগ উল্কা স্রোতে গলছে দরদীর...
                 মুগ্ধ চোখে দেখছি, শুধু হৃদয় তখনও কাঁপা
                তোমার পাড়িয়ে যাওয়া ফুলই; আমার কনকচাঁপা!
                তবু তোমার ফেলে আসা জিভে; রয়ে গেছে প্রায়শ্চিত্ত-
               এ যুগে দিব্যিরা বড়ই দুর্বল তবু বহুল প্রচলিত।
               জোনাকি মিশ্রিত হৃদ বুকের কোনও প্রথায়...
               জেনে রাখো মেহবুব সাজিয়েছে ফুল লতায়পাতায়।
               হাতে হাত রেখে আলো আঁধারির কোনও সন্ধ্যায়
               ভালোবাসার গভীরে; প্রবলতম বুকের অধ্যায়...
              তারপর বহুদিন পেন্সিলের দাগ মুছে নিয়ে সিলেটে-
              কিছু অক্ষত স্মৃতিদের ভুলিয়ে দিতে দিতে...
             পালটে যায় রঙ, পালটে যায় মন ছদ্মবেশী হতে হতে
              তবে তুমিও আস্থা রেখো মূল্যহীন ফেরতের...

                     অস্থির স্নায়ুযুদ্ধরা
                       রাহুল গাঙ্গুলি

                    নদীটা চলছিল।থেমে গেলো হঠাৎ _____
                    স্নান করছিলো যারা
                   আচমনীয় রীতিনীতি থেকে ভাঙা সেতু
                   ছটফট্ ছটফট্।লালরঙ চিরকালই হিংসুটে
                  স্নানঘাট মনোরঞ্জন ~  ১লা মানুষ
                  নাহ।মানুষ নয় মহিলা
                  নাহ।মহিলা নয় মা
                 নাহ।মা নয় ~ ম-ম গন্ধের থ্যাঁতলানো যোনি
                 পুড়ে যাওয়ার শোধবোধ
                 নখের এক্কাদোক্কায় স্বয়ংক্রিয় ডিটোনেটর্
                লুকিয়ে থাকা শেকড় ঘটায় বিস্ফারণ
                নাহ।এটা ২০২০ নয়
                বরং ~ ২০৫০ সাল।ঘটছে।ঘটবে এবং ঘটবেই
                তার নামও প্রমীলা


               সরল বর্গীয় শব্দসমূহ
                          সায়ন্তিনী হোড়

                    ঘাসের ক্লিভেজ ছুঁয়ে যাওয়ার সময়
                   আকাশ ও অধ্যায়ের মধ্যে দূরত্ব তৈরী হয়
                  ঠোঁট গলে পড়লে
                  বুদবুদের গায়ে চুমুর চিহ্ন এঁকে দিই
                 পাখির পালকের শব্দচুর
                 আমার নথ ভেঙে দেয়,
                 তখন এক একটা নগ্ন অভিধানের সাথে
                 সম্পর্ক ছিন্ন হতে থাকে সরলবর্গীয় শব্দের
                লুপ্তপ্রায় আকাশের গলায় ভেসে ওঠে
                অভিযোগের আঙুল
                 দূরত্ব : অভিমানের  ঠোঁট  : শূন্যতা   

                   পৃথাগোরাসের গিটার
                                রথীন বণিক

              কুঁচানো গিলোটিন ভেঙে উঠে আসুক চাতাল
             এই ক্রমজমান ত্রিভুজে
             চোখ থেকে টিপটপ ইহলোক খুলে গেলে
            আর ডাকব না
            সফেন স্ট্রীমার
            রাশি রাশি আইওনক্সে
           এনো না অগোছালো পাহাড়
           ওই ঘনায়মান হারপিকে
           মিথ্যে মিথ্যে চুষে
          হেসে উঠুক পৃথাগোরাসের গিটার ।

                                    শেষ অংক 
                        বিমল মণ্ডল

                    অমাবস্যায় ব্যর্থ চাঁদ শুয়ে
                    অন্ধকার নামে তোমার উঠানে
                    মন ঢাকো নিরবধি
                    যন্ত্রণা তারাদের মাঝে
                    তবুও হেঁটে যাও  
                    অনবদ্য এক শব্দময়তায়
                    সারারাত আকাশ আকাশের বিলোল প্রাসাদে
                    স্বপ্নের জগতে মজেছে চাঁদ
                    তুমিও পরিচ্ছন্ন ভোরে
                    চাঁদে আগুনের
                    শেষঅঙ্ক দেখে গেলে! 
                                    ঠোঁট
                                        প্রদীপ সিং

                           গোলাপের পাপড়ির মতো -
                           লালরঙে বিকেলের কমনীয়তা ।
                           মনে হয় স্পর্শেই নেমে আসবে -
                          এক নাতিশীতোষ্ণ অনুভূতি ।
                          ভাঁজে ভাঁজে তার কামনার আকাঙ্ক্ষা ।
                          চুম্বনের অপেক্ষায় তার অপেক্ষা ।
                         ঠোঁট পাল্টে গেলে ,
                         উষ্ণতার কোমলতার ভাগে  ফারাক পড়ে না ?