প্রসঙ্গ: কবিতা ভাবনা
শঙ্কর ব্রহ্ম
শঙ্কর ব্রহ্ম
এক.
"কবি কোন তকমা নয়
কবি বিশেষ এক পরিচয়,
মনের ভাব যার কথায়
ছন্দে চিত্রে প্রকাশ পায়।"
কবি বিশেষ এক পরিচয়,
মনের ভাব যার কথায়
ছন্দে চিত্রে প্রকাশ পায়।"
সব বিদ্যে শেখানো যায়,
কবিতা লেখা শেখানো যায় না।
ওটা যার হয় তার হয়,
ভিতরের ব্যাপার( অনুভূতির তীব্র আবেগে, প্রকাশের তাগিদ)।
তবে আজকাল বানানো কবিতার ছড়াছড়ি,চোখে পড়ে যার মধ্যে প্রাণের স্পর্শ পাওয়া যায় না।
কবিতা আসে স্বতস্ফূর্ত ভাবে,
ছন্দ মাত্রা তাল লয় ভেবে আসে না।
কবি অনেক সময় তা নিয়ন্ত্রণ করে,
তার জ্ঞান বুদ্ধি শিক্ষা দিয়ে,কবিতা সে নিয়ন্ত্রণে,অনেক সময় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
ভিতরে কবিত্ব বোধ থাকলে তবেই হবে
নতুবা সবটাই যাবে ফাঁকি।
বিদেশে কবিতা লেখা শেখাবার কিছু স্কুল আছে,সেখানে লেখা শিখে কেউ বড় কবি হতে পেরেছেন বলে শোনা যায়নি।
কবি সুনীল গাঙ্গুলী ,সমরেন্দ্র সেনগুপ্তরাও কলকাতায় সে রকম একটা প্রচেষ্টা করেছিলেন ,কৃত্তিবাস পত্রিকার পক্ষ থেকে , সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি।
তারা কোন সৃষ্টিশীল কবি তৈরী করতে পারেননি,সেই পরিকল্পনা থেকে,ফলে তা অল্পকালের মধ্যেই পরিত্যাজ্য হয়।
ফরাসী কবি মালার্মে বলেছেন ,
কবি আসলে নিজের সাথে কথা বলে,
পাঠক শ্রোতারা আড়ি পেতে তা শোনেন।
কবিতা লেখা শেখানো যায় না।
ওটা যার হয় তার হয়,
ভিতরের ব্যাপার( অনুভূতির তীব্র আবেগে, প্রকাশের তাগিদ)।
তবে আজকাল বানানো কবিতার ছড়াছড়ি,চোখে পড়ে যার মধ্যে প্রাণের স্পর্শ পাওয়া যায় না।
কবিতা আসে স্বতস্ফূর্ত ভাবে,
ছন্দ মাত্রা তাল লয় ভেবে আসে না।
কবি অনেক সময় তা নিয়ন্ত্রণ করে,
তার জ্ঞান বুদ্ধি শিক্ষা দিয়ে,কবিতা সে নিয়ন্ত্রণে,অনেক সময় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
ভিতরে কবিত্ব বোধ থাকলে তবেই হবে
নতুবা সবটাই যাবে ফাঁকি।
বিদেশে কবিতা লেখা শেখাবার কিছু স্কুল আছে,সেখানে লেখা শিখে কেউ বড় কবি হতে পেরেছেন বলে শোনা যায়নি।
কবি সুনীল গাঙ্গুলী ,সমরেন্দ্র সেনগুপ্তরাও কলকাতায় সে রকম একটা প্রচেষ্টা করেছিলেন ,কৃত্তিবাস পত্রিকার পক্ষ থেকে , সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি।
তারা কোন সৃষ্টিশীল কবি তৈরী করতে পারেননি,সেই পরিকল্পনা থেকে,ফলে তা অল্পকালের মধ্যেই পরিত্যাজ্য হয়।
ফরাসী কবি মালার্মে বলেছেন ,
কবি আসলে নিজের সাথে কথা বলে,
পাঠক শ্রোতারা আড়ি পেতে তা শোনেন।
দুই.
দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে কবিতার সঙ্গে সহবাস আমার,তবু কতটুকু বুঝতে বা জানতে পেরেছি তাকে?
স্পষ্ট করে বলতে পারব না।
সে আজও আমার কাছে সম্পূর্ণ রহস্যময়,
আগের মতো সমান আকর্ষণীয়।
তবু যতটুকু বুঝেছি তাকে,
তা নিয়ে কিছু বলাটা বোধহয় অসমীচীন হবে না।
অন্য কোন কবির, কবিতা লেখার পদ্ধতির কথা জানি না।
তবে, নিজের লেখার পদ্ধতি নিয়ে কিছু কথা বলতে পারি,যা একান্ত ব্যক্তিগত,যদি কারও কোন উপকারে আসে, তাই বলা।
আমি কোন কবিতা লিখি না,বরং কবিতাই আমাকে দিয়ে কিছু লিখিয়ে নেয় ,কেমন করে তাও বলি শুনুন।
এক একটা পংক্তি এসে কোথা থেকে মাথায় ঢুকে পড়ে, আচমকাই।
তারপর সেটা মনে মনে লালন করার পর্ব শুরু হয়,দ্বিতীয় পংক্তির জন্য প্রার্থনা চলে,মনে মনে।সেটা কখন আসবে তা কেউ জানে না।
আমি মনেকরি, কবিতা লেখা পার্টটাইম জব নয়,ফুলটাইম ওয়ার্ক।নিরবিচ্ছিন্ন ব্যাপার,ভোরে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা থেকে শুরু হয় ,তারপর ঘুমের আগে অবধি চলে কবিতা সৃজনের কাজ মনে মনে।ঘুমের ভিতরও অনেক সময় চলে স্বপ্নে।
অনেক সময় মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে,হঠাৎ একটা পংক্তি এসে বিরক্ত শুরু করে,সকালে উঠে আর সেটা মনে থাকে না,তাই আমি তখনই পংক্তিটি লিখে রাখার চেষ্টা করি আজকাল।হাতের কাছে যা পাই তাতেই লিখে রাখি তখনকার মতো,প্রেসক্রীপশনের উল্টো পিঠে, ক্যালেন্ডারের ছেঁড়াপাতায়,লন্ড্রির বিল,কিংবা কিছু কেনাকাটার রসিদ ইত্যাদি হাতের কাছে যা পাই তাতেই।
সকালে উঠে, প্রাত্যহিক কাজ-কর্ম সেরে,চায়ে চুমুক দিতে দিতে,পংক্তিটি মনে মনে আওড়াই বার কয়েক।
ভিতরে ভিতরে কবিতাটি লেখার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় মনে মনে।
সব সময় সফল হই তা নয়, প্রায়শই বিফল হই,কখনও সখনও সফলতা আসে তার অনুগ্রহ পেলে।লেখাটা পূর্ণতা পায়।
নিজের মনপূত না হলে, তার উপরও কাঁটাকাটি চলে,যতক্ষণ না পর্যন্ত মন
তুষ্টি হয়।এইভাবেই আমার কবিতা লেখার প্রক্রিয়া চলে,বলা যায়।
কবিতার নিজস্ব একটা ভাষা আছে , তা আয়ত্ব করতে বহুদিন সময় লাগে,
দেশী বিদেশী ভাল ভাল কবিতা পড়তে হয় বারবার,অনুসন্ধিৎসু থাকতে হয় মনে মনে, পূর্বসূরীদের লেখা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা একান্ত জরুরী,হঠাৎ ভূঁই ফোড়ের মতো কিছু হয় না।
ভাবতে হয় সে'সব লেখা নিয়ে নিয়মিত, দীর্ঘদিন এ'রকম প্রচেষ্টার ফলে, তা কিছুটা আয়ত্বাধীন হয়।
তারপর চলে নিজের মতো করে পরীক্ষা নীরিক্ষার কাজ।সেটা মোটেই সহজ ব্যাপার নয় ।
হঠাৎ করে এসব আয়ত্ব করা যায় না।
যারা এ'কথা বোঝেন না, কিংবা মানেন না,তাদের কবিতা লেখার প্রচেষ্টা, ছন্দ মিলিয়ে পদ্য লেখা ছাড়া,আর বেশী কিছু হয় বলে আমার মনে হয় না।
সে'রকম লেখাই আজকাল অনেক চোখে পড়ে, যাতে প্রাণের সাড়া মেলে না।
মূর্তি গড়া হয় বটে,তা কখনই প্রতিমা হয়ে ওঠে না।
কবিতা তো তাই যা সহজেই মানুষের চিত্ত চাঞ্চল্য ঘটায়,মনে করুণার উদ্রেক করে,নর নারীর বন্ধনকে মধুর করে,এবং হিস্র যোদ্ধার মনেও সান্ত্বনা এনে দেয়।
মানুষ কাব্যে সান্ত্বনা খোঁজে, জীবনের দিকদর্শন চায়,আনন্দ খোঁজে এই নিরানন্দময় জীবনে।আমার তো মনে হয় তাই।নতুবা পাঠক অযথা কবিতা পড়তে যাবেন কেন,আজকের এই ইন্টারনেটের যুগে,যেখানে মানসিক উপভোগের সব রকম সামগ্রীই সহজলভ্য।
বস্তুতঃ বহু শতাব্দী ধরে এ'কারণেই, কবিতা টিঁকে আছে আজও তার নিজস্ব সত্তা ও অস্তিত্ব নিয়ে,বহাল তবিয়তে।
এ'ব্যাপারে পাঠকদের সুচিন্তিত মতামত প্রত্যাশা করি।
স্পষ্ট করে বলতে পারব না।
সে আজও আমার কাছে সম্পূর্ণ রহস্যময়,
আগের মতো সমান আকর্ষণীয়।
তবু যতটুকু বুঝেছি তাকে,
তা নিয়ে কিছু বলাটা বোধহয় অসমীচীন হবে না।
অন্য কোন কবির, কবিতা লেখার পদ্ধতির কথা জানি না।
তবে, নিজের লেখার পদ্ধতি নিয়ে কিছু কথা বলতে পারি,যা একান্ত ব্যক্তিগত,যদি কারও কোন উপকারে আসে, তাই বলা।
আমি কোন কবিতা লিখি না,বরং কবিতাই আমাকে দিয়ে কিছু লিখিয়ে নেয় ,কেমন করে তাও বলি শুনুন।
এক একটা পংক্তি এসে কোথা থেকে মাথায় ঢুকে পড়ে, আচমকাই।
তারপর সেটা মনে মনে লালন করার পর্ব শুরু হয়,দ্বিতীয় পংক্তির জন্য প্রার্থনা চলে,মনে মনে।সেটা কখন আসবে তা কেউ জানে না।
আমি মনেকরি, কবিতা লেখা পার্টটাইম জব নয়,ফুলটাইম ওয়ার্ক।নিরবিচ্ছিন্ন ব্যাপার,ভোরে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা থেকে শুরু হয় ,তারপর ঘুমের আগে অবধি চলে কবিতা সৃজনের কাজ মনে মনে।ঘুমের ভিতরও অনেক সময় চলে স্বপ্নে।
অনেক সময় মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে,হঠাৎ একটা পংক্তি এসে বিরক্ত শুরু করে,সকালে উঠে আর সেটা মনে থাকে না,তাই আমি তখনই পংক্তিটি লিখে রাখার চেষ্টা করি আজকাল।হাতের কাছে যা পাই তাতেই লিখে রাখি তখনকার মতো,প্রেসক্রীপশনের উল্টো পিঠে, ক্যালেন্ডারের ছেঁড়াপাতায়,লন্ড্রির বিল,কিংবা কিছু কেনাকাটার রসিদ ইত্যাদি হাতের কাছে যা পাই তাতেই।
সকালে উঠে, প্রাত্যহিক কাজ-কর্ম সেরে,চায়ে চুমুক দিতে দিতে,পংক্তিটি মনে মনে আওড়াই বার কয়েক।
ভিতরে ভিতরে কবিতাটি লেখার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় মনে মনে।
সব সময় সফল হই তা নয়, প্রায়শই বিফল হই,কখনও সখনও সফলতা আসে তার অনুগ্রহ পেলে।লেখাটা পূর্ণতা পায়।
নিজের মনপূত না হলে, তার উপরও কাঁটাকাটি চলে,যতক্ষণ না পর্যন্ত মন
তুষ্টি হয়।এইভাবেই আমার কবিতা লেখার প্রক্রিয়া চলে,বলা যায়।
কবিতার নিজস্ব একটা ভাষা আছে , তা আয়ত্ব করতে বহুদিন সময় লাগে,
দেশী বিদেশী ভাল ভাল কবিতা পড়তে হয় বারবার,অনুসন্ধিৎসু থাকতে হয় মনে মনে, পূর্বসূরীদের লেখা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা একান্ত জরুরী,হঠাৎ ভূঁই ফোড়ের মতো কিছু হয় না।
ভাবতে হয় সে'সব লেখা নিয়ে নিয়মিত, দীর্ঘদিন এ'রকম প্রচেষ্টার ফলে, তা কিছুটা আয়ত্বাধীন হয়।
তারপর চলে নিজের মতো করে পরীক্ষা নীরিক্ষার কাজ।সেটা মোটেই সহজ ব্যাপার নয় ।
হঠাৎ করে এসব আয়ত্ব করা যায় না।
যারা এ'কথা বোঝেন না, কিংবা মানেন না,তাদের কবিতা লেখার প্রচেষ্টা, ছন্দ মিলিয়ে পদ্য লেখা ছাড়া,আর বেশী কিছু হয় বলে আমার মনে হয় না।
সে'রকম লেখাই আজকাল অনেক চোখে পড়ে, যাতে প্রাণের সাড়া মেলে না।
মূর্তি গড়া হয় বটে,তা কখনই প্রতিমা হয়ে ওঠে না।
কবিতা তো তাই যা সহজেই মানুষের চিত্ত চাঞ্চল্য ঘটায়,মনে করুণার উদ্রেক করে,নর নারীর বন্ধনকে মধুর করে,এবং হিস্র যোদ্ধার মনেও সান্ত্বনা এনে দেয়।
মানুষ কাব্যে সান্ত্বনা খোঁজে, জীবনের দিকদর্শন চায়,আনন্দ খোঁজে এই নিরানন্দময় জীবনে।আমার তো মনে হয় তাই।নতুবা পাঠক অযথা কবিতা পড়তে যাবেন কেন,আজকের এই ইন্টারনেটের যুগে,যেখানে মানসিক উপভোগের সব রকম সামগ্রীই সহজলভ্য।
বস্তুতঃ বহু শতাব্দী ধরে এ'কারণেই, কবিতা টিঁকে আছে আজও তার নিজস্ব সত্তা ও অস্তিত্ব নিয়ে,বহাল তবিয়তে।
এ'ব্যাপারে পাঠকদের সুচিন্তিত মতামত প্রত্যাশা করি।
তিন.
কবিতা সরাসরি কথা বলে না।কবিতা লেখা হয় সান্ধ্যভাষায়,তাই বহুক্ষেত্রে
কবিতার ভাষা ইঙ্গিতবাহী, শঙ্খ ঘোষ যাকে বলেন, কবিতার অবগুন্ঠণ।
সে ইঙ্গিত সূক্ষ্ম হতে পারে, আবার স্থুলও হতে পারে।
স্থুল ইঙ্গিত কবিতার নিয়মিত পাঠকেরা সহজেই ধরতে পারেন,বুঝতে পারেন।
সূক্ষ্ম ইঙ্গিত সকলের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় বলে,সে'সব কবিতাগুলো দূরহ মনে হয়, তাদের কাছে।দুর্বোধ্যতা ভিন্ন ব্যাপার।
সূক্ষ অনুভূতিতন্ত্রের লোকেরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারে সে'সব লেখা,অবশ্য তাদের সংখ্যা খুবই কম।
কবিতা ভাষা যেহেতু ইঙ্গিতবাহী সেকারণে - রূপক,চিত্রকল্প,উৎপ্রেক্ষণ,
নিপুন শব্দ ব্যাবহারের নিপুন দক্ষতা,সব কিছুই বিশেষ ভাবে ফুটে ওঠে কবির কবিতায়।
অবশ্য কবিতা লেখার সময় এতসব ভেবে কবিতা লেখা হয় না।লেখা যায় না।
কবিতা লেখার পূর্বেই এ'সব নির্দিষ্ট প্রক্রিয়াগুলে চলতে থাকে নিঃশব্দে, ভিতরে ভিতরে।এইসব প্রক্রিয়াগুলো,
মানসিক ভাবে কবিকে তৃপ্ত করলে,তবেই কবিতাটি ভূমিষ্ট হবার সুযোগ পায়।
কবি তার প্রয়োজনে ছন্দকে ব্যবহার করেন তার কবিতায়,অবশ্য সর্বদাই সে ছন্দের অনুশাসন মেনে চলবেন এমন কোন কথা নেই।কোথায়ও ছন্দের একচুল কম বেশী হলে, তিনি গায়ে মাখেন না।কবির মূখ্য লক্ষ্য থাকে কবিতাটির সুষ্ঠ বিন্যাস।তিনি মনে করেন,ছন্দ যদি পুরোপুরি কবিতাকে শাসন করে, তবে
অনেক সময়,কবিতার স্বতঃস্ফূর্ততা নষ্ট হয়।কবিতা খর্ব হয়ে পড়ার সম্ভবনা থেকেই যায়।
অবশ্য ছান্দসিকের সেটা মনঃপূত
না হতেই পারে, তাতে কবির কিছু এসে যায় না।
তারা ভুলে যান, কবিতার জন্যই ছন্দ,ছন্দের জন্য কবিতা নয়।ছন্দ কবিতার বাহন মাত্র,তার বেশী কিছু নয়।
ছন্দ মানুষকে বেশী মাতাতে পারে, তার একটা চুম্বক আকর্ষ আছে,যা যে কোন প্রাণীকেই অমোঘ ভাবে টানে। তাই
কবিতায় ছন্দ অপরিহার্য না হলেও কাঙ্খিত।কারণ, তাতে সহজেই মানুষের মনে দোলা দিয়ে,কবিতার ভাব সঞ্চারে সহজ সহায়তা করে।
কবি জীবনানন্দ দাশ মনে করতেন,
কোন কবিতা ছন্দে লেখা হবে, তা ভিতরে ভিতরেই ঠিক হয়ে যায়,কবিতাটি ভূমিষ্ট হবার পূর্বেই।
প্রত্যেক মনীষারই এক বিশেষ ক্ষমতা থাকে,সে তার নিজের জগতে সিদ্ধ,কবির সিদ্ধিও তার কাব্য সৃষ্টির ভিতরে।অবশ্য তার মানে এই নয় যে কবি ব্যবহারিক জীবনে অকর্মণ্য,বরং সাধারণ বুদ্ধিমান লোকের মত,সে তার ব্যবহারিক প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম।
কবিতা মূলত লোকশিক্ষা নয়,কিংবা তাকে রসসিক্ত করে পরিবেশন নয়,তাই যদি হতো তবে "সদ্ভাব শতক" শ্রেষ্ট কাব্যের মর্যাদা পেত,তা কিন্তু পায়নি।
স্লোগান কিংবা কোন বাণীও সেই অর্থে কবিতা নয়।তাহলে " সদ্ভাব-শতক"কে
সকলেই কাব্যগ্রন্থ ভাবত।কি তা কেউ ভাবে না।
সামজিক পরিবর্তেন দায় কবির নিজের ঘাড়ে না নেওয়াই বাঞ্ছণীয়।তার জন্য সমাজপতিরা রয়েছেন। কবির কাজ মজাজপতিত্বের দায় কাঁধে তুলে নেওয়া নয়।অবশ্য তার মানে এই নয় যে তিনি সমাজের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কনবেন না। অবশ্যই করবেন,
তা তার নিজস্ব ভাষার পরিমন্ডলের মধ্যে, তা কখনও, সমাজপতিদের মতো উচ্চকিত স্লোগান ধর্মী হবে না।কবি কখনই অসামজিক মানুষ নয়,ফলে তার কবিতায় সামাজিক প্রতিচ্ছবি ফুঠতে বাধ্য,সৎ কিবি কখনই সমাজ ত্যাগ করে গজদন্ত মিনারে বাস করে কবিতা লেখেন না আজকাল।তিনি আর পাঁচ জন মানুষের মতো এই সমাজেরই একজন অধিবাসী।ফলে সমাজের ভালমন্দের দায় তার উপরও বর্তায়। তিনি সমাজের সঙ্কটময় মুহূর্তে নীরব থাকতে পারেন না।
এই জন্যই বোধহয়,দার্শনিক এরিস্টটল কবিকে সমাজের সদা জাগ্রত প্রহরী বলে
অভিহিত করেছেন।
অবশ্য তার গুরু সক্রেটিস ভাবতেন, সমাজে কবির কোন কাজ নেই,ফলে সমাজে তার কোন স্থান নেই।অসামাজিক মানুষ তিনি। কবি শঙ্খ ঘোষ যাকে শ্লেষ করে অনায়াসে বলেছেন,"মূর্খ বড়,সামাজিক নয়"।
কবিতা পাঠ একটা একটা সতন্ত্র রসাস্বাদনের ব্যাপার।সে স্বাদ গ্রহনের জন্য পাঠকেরও প্রয়োজন হয় মনে মনে প্রস্তুতি গ্রহনের,নতুবা তার কাছে, সে'রসের স্বাদ অধরাই থেকে যায় আজীবন।
কবিতার ভাষা ইঙ্গিতবাহী, শঙ্খ ঘোষ যাকে বলেন, কবিতার অবগুন্ঠণ।
সে ইঙ্গিত সূক্ষ্ম হতে পারে, আবার স্থুলও হতে পারে।
স্থুল ইঙ্গিত কবিতার নিয়মিত পাঠকেরা সহজেই ধরতে পারেন,বুঝতে পারেন।
সূক্ষ্ম ইঙ্গিত সকলের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় বলে,সে'সব কবিতাগুলো দূরহ মনে হয়, তাদের কাছে।দুর্বোধ্যতা ভিন্ন ব্যাপার।
সূক্ষ অনুভূতিতন্ত্রের লোকেরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারে সে'সব লেখা,অবশ্য তাদের সংখ্যা খুবই কম।
কবিতা ভাষা যেহেতু ইঙ্গিতবাহী সেকারণে - রূপক,চিত্রকল্প,উৎপ্রেক্ষণ,
নিপুন শব্দ ব্যাবহারের নিপুন দক্ষতা,সব কিছুই বিশেষ ভাবে ফুটে ওঠে কবির কবিতায়।
অবশ্য কবিতা লেখার সময় এতসব ভেবে কবিতা লেখা হয় না।লেখা যায় না।
কবিতা লেখার পূর্বেই এ'সব নির্দিষ্ট প্রক্রিয়াগুলে চলতে থাকে নিঃশব্দে, ভিতরে ভিতরে।এইসব প্রক্রিয়াগুলো,
মানসিক ভাবে কবিকে তৃপ্ত করলে,তবেই কবিতাটি ভূমিষ্ট হবার সুযোগ পায়।
কবি তার প্রয়োজনে ছন্দকে ব্যবহার করেন তার কবিতায়,অবশ্য সর্বদাই সে ছন্দের অনুশাসন মেনে চলবেন এমন কোন কথা নেই।কোথায়ও ছন্দের একচুল কম বেশী হলে, তিনি গায়ে মাখেন না।কবির মূখ্য লক্ষ্য থাকে কবিতাটির সুষ্ঠ বিন্যাস।তিনি মনে করেন,ছন্দ যদি পুরোপুরি কবিতাকে শাসন করে, তবে
অনেক সময়,কবিতার স্বতঃস্ফূর্ততা নষ্ট হয়।কবিতা খর্ব হয়ে পড়ার সম্ভবনা থেকেই যায়।
অবশ্য ছান্দসিকের সেটা মনঃপূত
না হতেই পারে, তাতে কবির কিছু এসে যায় না।
তারা ভুলে যান, কবিতার জন্যই ছন্দ,ছন্দের জন্য কবিতা নয়।ছন্দ কবিতার বাহন মাত্র,তার বেশী কিছু নয়।
ছন্দ মানুষকে বেশী মাতাতে পারে, তার একটা চুম্বক আকর্ষ আছে,যা যে কোন প্রাণীকেই অমোঘ ভাবে টানে। তাই
কবিতায় ছন্দ অপরিহার্য না হলেও কাঙ্খিত।কারণ, তাতে সহজেই মানুষের মনে দোলা দিয়ে,কবিতার ভাব সঞ্চারে সহজ সহায়তা করে।
কবি জীবনানন্দ দাশ মনে করতেন,
কোন কবিতা ছন্দে লেখা হবে, তা ভিতরে ভিতরেই ঠিক হয়ে যায়,কবিতাটি ভূমিষ্ট হবার পূর্বেই।
প্রত্যেক মনীষারই এক বিশেষ ক্ষমতা থাকে,সে তার নিজের জগতে সিদ্ধ,কবির সিদ্ধিও তার কাব্য সৃষ্টির ভিতরে।অবশ্য তার মানে এই নয় যে কবি ব্যবহারিক জীবনে অকর্মণ্য,বরং সাধারণ বুদ্ধিমান লোকের মত,সে তার ব্যবহারিক প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম।
কবিতা মূলত লোকশিক্ষা নয়,কিংবা তাকে রসসিক্ত করে পরিবেশন নয়,তাই যদি হতো তবে "সদ্ভাব শতক" শ্রেষ্ট কাব্যের মর্যাদা পেত,তা কিন্তু পায়নি।
স্লোগান কিংবা কোন বাণীও সেই অর্থে কবিতা নয়।তাহলে " সদ্ভাব-শতক"কে
সকলেই কাব্যগ্রন্থ ভাবত।কি তা কেউ ভাবে না।
সামজিক পরিবর্তেন দায় কবির নিজের ঘাড়ে না নেওয়াই বাঞ্ছণীয়।তার জন্য সমাজপতিরা রয়েছেন। কবির কাজ মজাজপতিত্বের দায় কাঁধে তুলে নেওয়া নয়।অবশ্য তার মানে এই নয় যে তিনি সমাজের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কনবেন না। অবশ্যই করবেন,
তা তার নিজস্ব ভাষার পরিমন্ডলের মধ্যে, তা কখনও, সমাজপতিদের মতো উচ্চকিত স্লোগান ধর্মী হবে না।কবি কখনই অসামজিক মানুষ নয়,ফলে তার কবিতায় সামাজিক প্রতিচ্ছবি ফুঠতে বাধ্য,সৎ কিবি কখনই সমাজ ত্যাগ করে গজদন্ত মিনারে বাস করে কবিতা লেখেন না আজকাল।তিনি আর পাঁচ জন মানুষের মতো এই সমাজেরই একজন অধিবাসী।ফলে সমাজের ভালমন্দের দায় তার উপরও বর্তায়। তিনি সমাজের সঙ্কটময় মুহূর্তে নীরব থাকতে পারেন না।
এই জন্যই বোধহয়,দার্শনিক এরিস্টটল কবিকে সমাজের সদা জাগ্রত প্রহরী বলে
অভিহিত করেছেন।
অবশ্য তার গুরু সক্রেটিস ভাবতেন, সমাজে কবির কোন কাজ নেই,ফলে সমাজে তার কোন স্থান নেই।অসামাজিক মানুষ তিনি। কবি শঙ্খ ঘোষ যাকে শ্লেষ করে অনায়াসে বলেছেন,"মূর্খ বড়,সামাজিক নয়"।
কবিতা পাঠ একটা একটা সতন্ত্র রসাস্বাদনের ব্যাপার।সে স্বাদ গ্রহনের জন্য পাঠকেরও প্রয়োজন হয় মনে মনে প্রস্তুতি গ্রহনের,নতুবা তার কাছে, সে'রসের স্বাদ অধরাই থেকে যায় আজীবন।
চার.
কবিতায় কবি কথা বলে।
কিন্তু কার সঙ্গে কথা বলে?
কবি মালার্মে কথিত, শুধু নিজের সঙ্গে?তাই যদি হবে, তবে কবি আর পাগলের বিশেষ তফাৎ থাকে না। একটা তফাৎ থাকে অবশ্য। পাগল নিজের সঙ্গে কথা বলেই তার কর্তব্য সম্পাদন করে। পাগলকে তা লিখে রাখতে হয় না।
কবিকে তার কথা লিখে রাখতে হয়। কেন লিখে রাখতে হয় তবে?
কাউকে শোনাবার জন্যই তো?
কিন্তু কেউ শুনবে কেন,তার আবোল তাবোল বলা কথাগুলো,যদি না তাতে পাঠকের মনে রস সঞ্চার হয়? যদি না তার অুনুভূতি তন্ত্রীতে আলোড়ন তোলে?
তাহলে শেষ পর্যন্ত কথাটা দাঁড়াচ্ছে, কবি নিজের সঙ্গে কথা বললেও,সে চায় তার কথাগুলো পাঠকের দরবারে পৌঁছে দিতে।তাই সে কথাগুলো লিখে রাখে,ছাপতে দেয়।
পাগলের সে সব কোন দায় থাকে না।
তবে কবিকে পাগল না বললেও বাতুল বলা চলে।
কবি অনেক কথা বানিয়ে, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বেশী করে বলেন। আর তা করতে গিয়েই তাকে কবিতার ভাষার আশ্রয় নিতে হয়। আশ্রয় নিতে উপমা, চিত্রকল্প,ছন্দ, রূপক,উৎপ্রেক্ষণ,
ইঙ্গিতময় সান্ধ্যভাষার।
আগেই বলেছি,কবিতার একটা নিজস্ব ভাষা আছে, সে ভাষা দীর্ঘদিন প্রচেষ্টায় রপ্ত করতে হয়। সে ভাষা
ইঙ্গিতময় এবং কথ্যরীতিতে বলা চলে,
শঙ্খ ঘোষ যাকে বলেছেন,বাকছন্দ।
কিন্তু কার সঙ্গে কথা বলে?
কবি মালার্মে কথিত, শুধু নিজের সঙ্গে?তাই যদি হবে, তবে কবি আর পাগলের বিশেষ তফাৎ থাকে না। একটা তফাৎ থাকে অবশ্য। পাগল নিজের সঙ্গে কথা বলেই তার কর্তব্য সম্পাদন করে। পাগলকে তা লিখে রাখতে হয় না।
কবিকে তার কথা লিখে রাখতে হয়। কেন লিখে রাখতে হয় তবে?
কাউকে শোনাবার জন্যই তো?
কিন্তু কেউ শুনবে কেন,তার আবোল তাবোল বলা কথাগুলো,যদি না তাতে পাঠকের মনে রস সঞ্চার হয়? যদি না তার অুনুভূতি তন্ত্রীতে আলোড়ন তোলে?
তাহলে শেষ পর্যন্ত কথাটা দাঁড়াচ্ছে, কবি নিজের সঙ্গে কথা বললেও,সে চায় তার কথাগুলো পাঠকের দরবারে পৌঁছে দিতে।তাই সে কথাগুলো লিখে রাখে,ছাপতে দেয়।
পাগলের সে সব কোন দায় থাকে না।
তবে কবিকে পাগল না বললেও বাতুল বলা চলে।
কবি অনেক কথা বানিয়ে, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বেশী করে বলেন। আর তা করতে গিয়েই তাকে কবিতার ভাষার আশ্রয় নিতে হয়। আশ্রয় নিতে উপমা, চিত্রকল্প,ছন্দ, রূপক,উৎপ্রেক্ষণ,
ইঙ্গিতময় সান্ধ্যভাষার।
আগেই বলেছি,কবিতার একটা নিজস্ব ভাষা আছে, সে ভাষা দীর্ঘদিন প্রচেষ্টায় রপ্ত করতে হয়। সে ভাষা
ইঙ্গিতময় এবং কথ্যরীতিতে বলা চলে,
শঙ্খ ঘোষ যাকে বলেছেন,বাকছন্দ।
কার কাছে কবিতা কি ভাবে আসবে,সেটা নির্ভর করে কবির ব্যক্তি সত্তার উপর।
তার মানসিকতা, রুচি,পাঠাভ্যাস,অধিত বিদ্যা,প্রিয় কবির প্রভাব,পারিপার্শিক পরিস্থিতি,সহযোগী সঙ্গ যাপন প্রভৃতি জটিল প্রক্রিয়ার উপর।
একটা রহস্যময় ব্যাপার,য্ কোন কবিই বোধহয় পুরোপুরি ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে
পারেন না। কারণ তারা নিজেরাও বোঝেন না সবটা পুরোপুরি এই কুহেলিকার।
কেউ কেউ, মালার্মের মতো মনে করেন, কবিতা শুধু কবির নিজস্ব অনুভূতির উন্মেষ,সেই কবিতা পাঠকের বোঝার ব্যাপারে,কবির কোন দায় নেই।
এ'কথা শুনতে যতোই কাব্যিক মনে হোক, পুরোপুরি মানতে দ্বিধা হয়।
পাঠকের প্রবেশের জন্য দরজা জানলা খোলা না থাকলে,পাঠকেরও কোন দায় থাকে না, সে বদ্ধ গুদামে প্রবেশের।
কবিতায় কবি নিজের সঙ্গে যতই না কথা বলুক,তার একটা সংযোগ যদি পাঠকের সঙ্গে না ঘটে, তবে পাগলের প্রলাপ ছাড়া, তাকে আ র বেশী কিছু বলা চলে না। পাগলও নিজের সঙ্গে কথা বলে,কারও কোন দায় থাকে কি সে কথা শোনার?
কবির লেখা যদি পাঠকরা পড়ে কিছুই না বুঝতে পারে,তবে তারা আগ্রহ বোধ করবে কেন কবিতা পাঠে? তবে সে লেখার সার্থকতা কোথায়?
এই প্রসঙ্গে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের
সঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের পত্রালাপ মনে পড়ছে।
কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত চাইতেন, পাঠকের অলস মনের জড়তা কাটাবার জন্য কবিতায় অপ্রচলিত শব্দের ব্যাবহার। তার যুক্তি ছিল, শব্দবাধায় ঠোক্কর খেয়ে, অনেকেই হয়তো ঘরে ফিরবে,কিন্তু তার পরেও যারা এগোবে,তারা অন্তত চলবে চোখ খুলে,কান মেলে প্রতি অগ্র পশ্চাৎ উর্ধ্ব অধঃ দেখতে দেখতে। এখানে অলঙ্কারের কথাও বলে নিই কেননা অলঙ্কার চিন্তাকে পরিস্ফূট করার বিশেষ সহায়। উপমানের সঙ্গে উপমার এত নিবিড় সম্পর্ক যে প্রথমটির স্বভাব অন্তত আংশিক ভাবে হলেও এসে পড়ে। কাজেই উপমার ভিতরেও একটা সামঞ্জস্য,একটা ন্যায় সঙ্গতি না থাকলে মুস্কিল।কিন্তু তাই বলে উপমাগুলিকে গতানুগতিক হতে হবে তার কোন মানে নেই, বরং উল্টোটাই ভালো।সত্যকে নতুন ভাবে দেখতে গিয়ে নূতন রূপকের দরকার হওয়া স্বাভাবিক।
তিনি আরও বলেছেন, যারা কবিতাকে ছুটির সাথী বলে ভাবে,কবিতার প্রতি ছত্র পড়ে হৃদকম্পন অনুভব করতে চায়, তাদের কবিতা না পড়াই উচিৎ।কবিতার গঠন যেমন প্রত্যেক লাইন বিশ্লেষণ করে ধরা যায় না, তার ভাবাবেশও তেমনি খন্ডাকারে দেখা যায় না,বিরাজমান থাকে সমগ্রের মধ্যে।
ভাব শুধু মেঘ বাঁশি প্রিয়া বিরহ মিলন
ইত্যাদি জরাজীর্ণ শব্দের করতলগত নয়,শুধু প্রেম বেদনা ও প্রকৃতিকে নিয়েই কাব্যের কারবার চলে না,তার লোলুপ হাত দর্শন- বিজ্ঞানের দিকেও আম্তে আম্তে প্র প্রসারিত হচ্ছে।
এই " বিশেষ জ্ঞানে"র দিনে কাব্যের তরফ থেকে আমি পাঠকের কাছে,সেই নিবিষ্ট ভিক্ষা করি যেটা সাধারণ অর্পিত হয় অন্যান্য আর্টের প্রতি।
বুদ্ধিমান অধ্যাবসায়ী পাঠকদের জন্য কবিতা লিখতেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত।
রবীন্দ্রনাথের এ'মতে সায় ছিল না।
তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে জানিয়ে ছিলেন,
" মানুষের মধ্যে, যে লোকটা বুদ্ধিমান তার দাবীর দিকে না তাকিয়ে, যে লোকটা রসবিলাসী তাকে খুশি করার চেষ্টা কর।
বুদ্ধিমানদের জন্য আছেন আইনস্টাইন,
ব্রার্টান্ড রাসেল,প্রশান্ত মহালনবিশ,সুনীতি চাটুজ্জে মস্ত মস্ত লোক সব।"
অথচ তিনি পাঠকরুচির কাছে আত্মসমর্পণের ঘোর বিরোধী ছিলেন।তাতে সস্তা সাহিত্যের আমদানী ঘটে এ'বোধ তার তীব্র ছিল।তার ভাষায়, "আদর্শ রক্ষা করতে গেলে প্রায়াসের দরকার,সাধনা না হলে চলে না।"
কবি জীবনানন্দ দাশের কথায়,
" কাব্যে কল্পনার ভিতর,চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা থাকবে।"
চিন্তা ও চেতনার কবির যেমন এক নিজস্ব জগৎ আছে।বাস্তব অভিজ্ঞতাও
তার চিন্তা চেতনাকে আলোড়িত করে, প্রভাবিত করে,এবং কবি তা প্রকাশ করেন,তার নিজস্ব কল্পনার মাধ্যমে।
এবং সে কল্পনাকে জাগরুক করতে হলে, তাকে আশ্রয় নিতে হয়,কখনও চিত্রকল্পের,কখনও রূপকের,কখনও উৎপ্রেক্ষণের,কখনও ছন্দ মাধুর্যের,কখনও ইঙ্গিতময় সান্ধ্যভাষার, কখনও যথার্থ শব্দ ব্যবহারের দক্ষতার।সব মিলিয়েই কবিতাটা রূপ পরিগ্রহন করে শেষ পর্যন্ত।
এ'সব অনুভবের ব্যাপার,ব্যাখ্যা করে বোঝাতে গেলে,ভুল বোঝার সম্ভবনা থেকে যাবে, ঠিক মতো বোঝানো সম্ভব হবে না, হয় তো!
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেন,
" শব্দকে ব্রহ্ম বলা হয়।কবিতায় কথাই সব।কথায় কি না হয়? কবিতায় কথা মন্ত্রের মতো কাজ করে।কথার নড়চড় হলে কবিতা একদম দাঁড়ায় না।শব্দের মূল তত্ত্বের মধ্যেই নিহিত আছে কবিতার মূল কথা।কেননা,শব্দই হল কবিতার মূলাধার।"
বস্তুত,শব্দ বাছাইয়ের পার্থক্য থেকেই এক কবিকে অন্য কবির থেকে আলাদা করে চেনা যায়।মরা শব্দকেও ব্যবহারিক পারদর্শিতায় কবি জ্যান্ত করে তোলেন।
যথার্থ কবির কাছে কথার খেলাই কবিতা হয়ে ওঠে, যা ম্যাজিক সৃষ্টি করতে পারে পাঠকের মননে।
কথাটা যত সহজে বললাম আমি,
কাজটা মোটেই তত সহজ নয়, বরং কঠিন দূরহ ব্যাপার।তার জন্য প্রয়োজন হয়,রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, " কঠিন সাধনার"।
অনেক সাধনার ফলে, সিদ্ধি লাভ করা সম্ভব হয়। মহৎ চালাকির সাথে ফাঁকি দিয়ে এই কাজ সম্ভব হয় না।
তার মানসিকতা, রুচি,পাঠাভ্যাস,অধিত বিদ্যা,প্রিয় কবির প্রভাব,পারিপার্শিক পরিস্থিতি,সহযোগী সঙ্গ যাপন প্রভৃতি জটিল প্রক্রিয়ার উপর।
একটা রহস্যময় ব্যাপার,য্ কোন কবিই বোধহয় পুরোপুরি ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে
পারেন না। কারণ তারা নিজেরাও বোঝেন না সবটা পুরোপুরি এই কুহেলিকার।
কেউ কেউ, মালার্মের মতো মনে করেন, কবিতা শুধু কবির নিজস্ব অনুভূতির উন্মেষ,সেই কবিতা পাঠকের বোঝার ব্যাপারে,কবির কোন দায় নেই।
এ'কথা শুনতে যতোই কাব্যিক মনে হোক, পুরোপুরি মানতে দ্বিধা হয়।
পাঠকের প্রবেশের জন্য দরজা জানলা খোলা না থাকলে,পাঠকেরও কোন দায় থাকে না, সে বদ্ধ গুদামে প্রবেশের।
কবিতায় কবি নিজের সঙ্গে যতই না কথা বলুক,তার একটা সংযোগ যদি পাঠকের সঙ্গে না ঘটে, তবে পাগলের প্রলাপ ছাড়া, তাকে আ র বেশী কিছু বলা চলে না। পাগলও নিজের সঙ্গে কথা বলে,কারও কোন দায় থাকে কি সে কথা শোনার?
কবির লেখা যদি পাঠকরা পড়ে কিছুই না বুঝতে পারে,তবে তারা আগ্রহ বোধ করবে কেন কবিতা পাঠে? তবে সে লেখার সার্থকতা কোথায়?
এই প্রসঙ্গে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের
সঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের পত্রালাপ মনে পড়ছে।
কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত চাইতেন, পাঠকের অলস মনের জড়তা কাটাবার জন্য কবিতায় অপ্রচলিত শব্দের ব্যাবহার। তার যুক্তি ছিল, শব্দবাধায় ঠোক্কর খেয়ে, অনেকেই হয়তো ঘরে ফিরবে,কিন্তু তার পরেও যারা এগোবে,তারা অন্তত চলবে চোখ খুলে,কান মেলে প্রতি অগ্র পশ্চাৎ উর্ধ্ব অধঃ দেখতে দেখতে। এখানে অলঙ্কারের কথাও বলে নিই কেননা অলঙ্কার চিন্তাকে পরিস্ফূট করার বিশেষ সহায়। উপমানের সঙ্গে উপমার এত নিবিড় সম্পর্ক যে প্রথমটির স্বভাব অন্তত আংশিক ভাবে হলেও এসে পড়ে। কাজেই উপমার ভিতরেও একটা সামঞ্জস্য,একটা ন্যায় সঙ্গতি না থাকলে মুস্কিল।কিন্তু তাই বলে উপমাগুলিকে গতানুগতিক হতে হবে তার কোন মানে নেই, বরং উল্টোটাই ভালো।সত্যকে নতুন ভাবে দেখতে গিয়ে নূতন রূপকের দরকার হওয়া স্বাভাবিক।
তিনি আরও বলেছেন, যারা কবিতাকে ছুটির সাথী বলে ভাবে,কবিতার প্রতি ছত্র পড়ে হৃদকম্পন অনুভব করতে চায়, তাদের কবিতা না পড়াই উচিৎ।কবিতার গঠন যেমন প্রত্যেক লাইন বিশ্লেষণ করে ধরা যায় না, তার ভাবাবেশও তেমনি খন্ডাকারে দেখা যায় না,বিরাজমান থাকে সমগ্রের মধ্যে।
ভাব শুধু মেঘ বাঁশি প্রিয়া বিরহ মিলন
ইত্যাদি জরাজীর্ণ শব্দের করতলগত নয়,শুধু প্রেম বেদনা ও প্রকৃতিকে নিয়েই কাব্যের কারবার চলে না,তার লোলুপ হাত দর্শন- বিজ্ঞানের দিকেও আম্তে আম্তে প্র প্রসারিত হচ্ছে।
এই " বিশেষ জ্ঞানে"র দিনে কাব্যের তরফ থেকে আমি পাঠকের কাছে,সেই নিবিষ্ট ভিক্ষা করি যেটা সাধারণ অর্পিত হয় অন্যান্য আর্টের প্রতি।
বুদ্ধিমান অধ্যাবসায়ী পাঠকদের জন্য কবিতা লিখতেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত।
রবীন্দ্রনাথের এ'মতে সায় ছিল না।
তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে জানিয়ে ছিলেন,
" মানুষের মধ্যে, যে লোকটা বুদ্ধিমান তার দাবীর দিকে না তাকিয়ে, যে লোকটা রসবিলাসী তাকে খুশি করার চেষ্টা কর।
বুদ্ধিমানদের জন্য আছেন আইনস্টাইন,
ব্রার্টান্ড রাসেল,প্রশান্ত মহালনবিশ,সুনীতি চাটুজ্জে মস্ত মস্ত লোক সব।"
অথচ তিনি পাঠকরুচির কাছে আত্মসমর্পণের ঘোর বিরোধী ছিলেন।তাতে সস্তা সাহিত্যের আমদানী ঘটে এ'বোধ তার তীব্র ছিল।তার ভাষায়, "আদর্শ রক্ষা করতে গেলে প্রায়াসের দরকার,সাধনা না হলে চলে না।"
কবি জীবনানন্দ দাশের কথায়,
" কাব্যে কল্পনার ভিতর,চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা থাকবে।"
চিন্তা ও চেতনার কবির যেমন এক নিজস্ব জগৎ আছে।বাস্তব অভিজ্ঞতাও
তার চিন্তা চেতনাকে আলোড়িত করে, প্রভাবিত করে,এবং কবি তা প্রকাশ করেন,তার নিজস্ব কল্পনার মাধ্যমে।
এবং সে কল্পনাকে জাগরুক করতে হলে, তাকে আশ্রয় নিতে হয়,কখনও চিত্রকল্পের,কখনও রূপকের,কখনও উৎপ্রেক্ষণের,কখনও ছন্দ মাধুর্যের,কখনও ইঙ্গিতময় সান্ধ্যভাষার, কখনও যথার্থ শব্দ ব্যবহারের দক্ষতার।সব মিলিয়েই কবিতাটা রূপ পরিগ্রহন করে শেষ পর্যন্ত।
এ'সব অনুভবের ব্যাপার,ব্যাখ্যা করে বোঝাতে গেলে,ভুল বোঝার সম্ভবনা থেকে যাবে, ঠিক মতো বোঝানো সম্ভব হবে না, হয় তো!
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেন,
" শব্দকে ব্রহ্ম বলা হয়।কবিতায় কথাই সব।কথায় কি না হয়? কবিতায় কথা মন্ত্রের মতো কাজ করে।কথার নড়চড় হলে কবিতা একদম দাঁড়ায় না।শব্দের মূল তত্ত্বের মধ্যেই নিহিত আছে কবিতার মূল কথা।কেননা,শব্দই হল কবিতার মূলাধার।"
বস্তুত,শব্দ বাছাইয়ের পার্থক্য থেকেই এক কবিকে অন্য কবির থেকে আলাদা করে চেনা যায়।মরা শব্দকেও ব্যবহারিক পারদর্শিতায় কবি জ্যান্ত করে তোলেন।
যথার্থ কবির কাছে কথার খেলাই কবিতা হয়ে ওঠে, যা ম্যাজিক সৃষ্টি করতে পারে পাঠকের মননে।
কথাটা যত সহজে বললাম আমি,
কাজটা মোটেই তত সহজ নয়, বরং কঠিন দূরহ ব্যাপার।তার জন্য প্রয়োজন হয়,রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, " কঠিন সাধনার"।
অনেক সাধনার ফলে, সিদ্ধি লাভ করা সম্ভব হয়। মহৎ চালাকির সাথে ফাঁকি দিয়ে এই কাজ সম্ভব হয় না।
পাঁচ.
বিশেষ প্রকারের আনন্দ দেওয়াই কবিতার প্রধান কাজ।কবিতা পাঠের আনন্দ আর অন্য পাঁচ রকমের আনন্দ থেকে আলাদা,বুঝতে হবে।আর তা না হলে, সাধারণ আমোদ প্রমোদ বা কবিতা পড়ার আনন্দের মধ্যে কোন তফাৎ থাকে না।কবি ওয়ার্ডওয়ার্থ ও কোলরিজ কবিতা পাঠের আনন্দের মধ্য দিয়েই তার লক্ষণ বিচার করেছেন।তবে তারা কবিতা পাঠের আনন্দকে অন্যান্য আনন্দ থেকে আলাদা করে দেখাননি।ফলে,সমালোচনার হাত থেকে তারা রেহাই পাননি।
টলস্টয়ের মতে,"কবিতার কাজ যদি শুধু আনন্দ দানই হয়,তবে তাকে নৈতিকতার দিক থেকে কোন গৌরবের বস্তু মনে হয় না।কিংবা ট্রাজেডি যে ধরণের আনন্দ আমাদের দেয়, তাকে তো সাধারণ অর্থে আনন্দ বলা যায় না। পরের দুঃখে আনন্দ পাওয়া কোন গৌরবের বস্তু নয়।"
এই বিপর্যয় এড়াবার জন্য, গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল বললেন,ট্রাজেডিতে একধরণের বিশেষ আনন্দ আছে।কিন্তু সেই বিশেষ আনন্দ কি,তা আবার তিনি ব্যাখ্যা করেননি। দার্শনিক কান্টও,এই বিশেষ আনন্দের দ্বারা কাব্যর লক্ষণ বিচার করেছেন।সে আনন্দ-ইন্দ্রিয়জনিত সুখ,জ্ঞান ভিত্তিক কিংবা নীতি মূলক আনন্দ হতে পারে।সুতরাং কবিতা আমরা পড়ি,তা থেকে বিশেষ ধরণের আনন্দ পাই বলেই। কবি লংগাহনাস,কবিতা পাঠে,
"তূরীয় আনন্দের"কথা বলেছেন।আলংকারিক অভিনবগুপ্ত এই আনন্দকে
' অলৌকিক চমৎকার ' বলেছেন।অন্য ভারতীয় আলংকারিকরা এই আনন্দকে,
'ব্রহ্ম স্বাদ সহোদরা' আখ্যা দিয়েছেন।এর দ্বারা মনন তৃপ্ত হয়।
আর এই অলৌকিক আনন্দ সৃষ্টি করেন কবিরা,ভাষার মাধ্যমে। এই জন্যই বোধহয় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবিদের বলেছেন "ভাষার যাদুকর"।
কবি কবিতায় শুধু শব্দের অর্থ জ্ঞাপনের কাজটি করে সন্তষ্ট হতে পারেন না,তিনি শব্দের ধ্বনির সাহায্য নেন তার ভাব প্রকাশের জন্য,কবিতায় চমৎকারিত্ব সৃষ্টির জন্য।
এ তো গেল, কবিতায় আনন্দ দানের দিকটির কথা।
অন্যদিকে,কবি কীটস কবিকে 'সত্য ও সুন্দরের ' পূজারী বলে আখ্যা দিয়েছেন।ররীন্দনাথেরও এ'মতে সায় ছিল।
গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল কবিকে বলেছেন "সমাজের জাগ্রত প্রহরী"। অথচ তার গুরু সক্রেটিস বলেছেন,সমাজে কবির কোন ভূমিকাই নেই।সে সমাজে অপাংতেয়।সমাজে তার কোন দরকার নেই।সমাজ থেকে তাকে বহিষ্কার করা উচিৎ।
অথচ ভারতীয় ঋষিরা কবিকে এমন উচ্চ মর্যাদায় স্থান দিয়েছিলেন যে তারা মনে করতেন," কবিতা পাঠে ঈশ্বর প্রাপ্তির স্বাদ অনুভব যায়।"
কবিতা পাঠে সত্য ও সৌন্দর্যের উপলব্ধিতে, যে আনন্দ পাওয়া যায় সে আনন্দ বিশেষ ধরণের আনন্দ ,সাধারণ বা লৌকিক আনন্দ থেকে তা পৃথক,তা হল জ্ঞান উপলব্ধির আনন্দ।
ফরাসী কবি মালার্মে বলেছেন,কবি নিজের সাথে কথা বলে,আমরা পাঠকরা তা আড়ি পেতে শুনে,মজা বা আনন্দ পাই, আর তাই বলেই তা শুনি।কবির কাজ নয় তা শোনানো।
কবি জীবনানন্দ দাশ মনে করতেন,কবিরা যখন ভাবাক্রান্ত হন তখন কবিতা লেখেন, আবার কবি বিষ্ণু দে বলেন,'সংবাদ মূলত কাব্য'।
ধ্বনিকার আনন্দবর্ধন মনে করেন, কবিতায় শব্দ এমন ভাবে ব্যবহার করা হয় যে তাদের বাচ্যার্থের মধ্য দিয়ে এবং তাকে ছাড়িয়ে একটি ব্যঞ্জনার্থ প্রকাশিত হয়,যা কাব্যের প্রধান অর্থ হয়ে চিত্তকে দোলা দেয়,একটা চমৎকারিতার আস্বাদ দেয়।শরীরের লাবণ্য যেমন,শরীরের ভিতরেই প্রকাশিত হয়েও তা শরীর অতিক্রম করে একটি সতন্ত্রভাব বস্তু রূপে প্রতিভাত হয়,কাব্যের ধ্বনি সেই ভাবেই কবিতায় উপস্থিত হয়।ভাবকে রসে উন্নীত
করতে হলে, শব্দের বাচ্যার্থের চেয়ে,
তাদের ব্যাঞ্জনার্থের বেশি সাহায্য নিতে হয় তবুও এই রসই সেই কাব্যানন্দের স্বরূপ।
এত সব বিবেচনা করে অবশ্য কোন পাঠকই কবিতা পড়েন না।যারা কবিতা পড়েন তারা কবিতা পড়ে কিছু পান বলেই কবিতা পড়ে থাকেন বলে আমার মনেহয়।
টলস্টয়ের মতে,"কবিতার কাজ যদি শুধু আনন্দ দানই হয়,তবে তাকে নৈতিকতার দিক থেকে কোন গৌরবের বস্তু মনে হয় না।কিংবা ট্রাজেডি যে ধরণের আনন্দ আমাদের দেয়, তাকে তো সাধারণ অর্থে আনন্দ বলা যায় না। পরের দুঃখে আনন্দ পাওয়া কোন গৌরবের বস্তু নয়।"
এই বিপর্যয় এড়াবার জন্য, গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল বললেন,ট্রাজেডিতে একধরণের বিশেষ আনন্দ আছে।কিন্তু সেই বিশেষ আনন্দ কি,তা আবার তিনি ব্যাখ্যা করেননি। দার্শনিক কান্টও,এই বিশেষ আনন্দের দ্বারা কাব্যর লক্ষণ বিচার করেছেন।সে আনন্দ-ইন্দ্রিয়জনিত সুখ,জ্ঞান ভিত্তিক কিংবা নীতি মূলক আনন্দ হতে পারে।সুতরাং কবিতা আমরা পড়ি,তা থেকে বিশেষ ধরণের আনন্দ পাই বলেই। কবি লংগাহনাস,কবিতা পাঠে,
"তূরীয় আনন্দের"কথা বলেছেন।আলংকারিক অভিনবগুপ্ত এই আনন্দকে
' অলৌকিক চমৎকার ' বলেছেন।অন্য ভারতীয় আলংকারিকরা এই আনন্দকে,
'ব্রহ্ম স্বাদ সহোদরা' আখ্যা দিয়েছেন।এর দ্বারা মনন তৃপ্ত হয়।
আর এই অলৌকিক আনন্দ সৃষ্টি করেন কবিরা,ভাষার মাধ্যমে। এই জন্যই বোধহয় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবিদের বলেছেন "ভাষার যাদুকর"।
কবি কবিতায় শুধু শব্দের অর্থ জ্ঞাপনের কাজটি করে সন্তষ্ট হতে পারেন না,তিনি শব্দের ধ্বনির সাহায্য নেন তার ভাব প্রকাশের জন্য,কবিতায় চমৎকারিত্ব সৃষ্টির জন্য।
এ তো গেল, কবিতায় আনন্দ দানের দিকটির কথা।
অন্যদিকে,কবি কীটস কবিকে 'সত্য ও সুন্দরের ' পূজারী বলে আখ্যা দিয়েছেন।ররীন্দনাথেরও এ'মতে সায় ছিল।
গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল কবিকে বলেছেন "সমাজের জাগ্রত প্রহরী"। অথচ তার গুরু সক্রেটিস বলেছেন,সমাজে কবির কোন ভূমিকাই নেই।সে সমাজে অপাংতেয়।সমাজে তার কোন দরকার নেই।সমাজ থেকে তাকে বহিষ্কার করা উচিৎ।
অথচ ভারতীয় ঋষিরা কবিকে এমন উচ্চ মর্যাদায় স্থান দিয়েছিলেন যে তারা মনে করতেন," কবিতা পাঠে ঈশ্বর প্রাপ্তির স্বাদ অনুভব যায়।"
কবিতা পাঠে সত্য ও সৌন্দর্যের উপলব্ধিতে, যে আনন্দ পাওয়া যায় সে আনন্দ বিশেষ ধরণের আনন্দ ,সাধারণ বা লৌকিক আনন্দ থেকে তা পৃথক,তা হল জ্ঞান উপলব্ধির আনন্দ।
ফরাসী কবি মালার্মে বলেছেন,কবি নিজের সাথে কথা বলে,আমরা পাঠকরা তা আড়ি পেতে শুনে,মজা বা আনন্দ পাই, আর তাই বলেই তা শুনি।কবির কাজ নয় তা শোনানো।
কবি জীবনানন্দ দাশ মনে করতেন,কবিরা যখন ভাবাক্রান্ত হন তখন কবিতা লেখেন, আবার কবি বিষ্ণু দে বলেন,'সংবাদ মূলত কাব্য'।
ধ্বনিকার আনন্দবর্ধন মনে করেন, কবিতায় শব্দ এমন ভাবে ব্যবহার করা হয় যে তাদের বাচ্যার্থের মধ্য দিয়ে এবং তাকে ছাড়িয়ে একটি ব্যঞ্জনার্থ প্রকাশিত হয়,যা কাব্যের প্রধান অর্থ হয়ে চিত্তকে দোলা দেয়,একটা চমৎকারিতার আস্বাদ দেয়।শরীরের লাবণ্য যেমন,শরীরের ভিতরেই প্রকাশিত হয়েও তা শরীর অতিক্রম করে একটি সতন্ত্রভাব বস্তু রূপে প্রতিভাত হয়,কাব্যের ধ্বনি সেই ভাবেই কবিতায় উপস্থিত হয়।ভাবকে রসে উন্নীত
করতে হলে, শব্দের বাচ্যার্থের চেয়ে,
তাদের ব্যাঞ্জনার্থের বেশি সাহায্য নিতে হয় তবুও এই রসই সেই কাব্যানন্দের স্বরূপ।
এত সব বিবেচনা করে অবশ্য কোন পাঠকই কবিতা পড়েন না।যারা কবিতা পড়েন তারা কবিতা পড়ে কিছু পান বলেই কবিতা পড়ে থাকেন বলে আমার মনেহয়।