সোমবার, ৩০ মার্চ, ২০২০
কবিতা : মলয় রায় চৌধুরী
নখ কাটা ও প্রেম
মলয় রায়চৌধুরী
রবীন্দ্রনাথ, দেড়শ বছর পর একটা প্রশ্ন আপনাকে :
কে আপনার নখ কেটে দিত যখন বিদেশ-বিভুঁয়ে থাকতেন--
সেই বিদেশিনী ? নাকি চৌখশ সুন্দরী ভক্তিমতীরা ?
যুবতীরা আপনার হাতখানা কোলের ওপরে নিয়ে নখ
কেটে দিচ্ছেন, এরকম ফোটো কেউ তোলেনি যে !
ওকামপোর হাঁটুর ওপরে রাখা আপনার দর্শনীয় পা ?
মহাত্মা গান্ধীর দুই ডানা রাখবার সাথিনেরা
বোধহয় কেটে দিত নখ ; কেননা বার্ধক্যে পৌঁছে
নিজের পায়ের কাছে নেইলকাটার নিয়ে যাওয়া, ওফ, কি
কষ্টকর, আমার মতন বুড়ো যুবতী-সঙ্গীহীন পদ্যলিখিয়েরা
জানে ; প্রেম যে কখন বয়সের দাবি নিয়ে আসে !
ফিসফিসে-লোকে বলে সুনীলদার প্রতিটি নখের জন্য
উঠতি-কবিনী থাকে এক-একজন। জয় গোস্বামীরও
ছিল, তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে সমুদ্রের পাঁকে চোখ বুজে।
চাইবাসার ছোটোঘরে শক্তিদার নখ কেটে দিচ্ছেন প্রেমিকাটি
দেখেছি যৌবনে। বিজয়াদিদির নখ কেটে দেন কি শরৎ ?
যশোধরা তোর নখ কেটে কি দিয়েছে তৃণাঞ্জন কখনও ?
সুবোধ আপনি নখ কেটে দিয়েছেন মল্লিকার পা-দুখানি
কোলের ওপরে তুলে ? কবি কত একা টের পেতে তার পা-এ
তাকালেই বোঝা যায় । যেমন জীবনানন্দ, হাজার বছর
খুঁজে চলেছেন কোনো এক বনলতা নখ কেটে দিয়ে যাবে তাঁর...।
কবিতা : অনুরুপা পাল চৌধুরী
অনুরূপা পালচৌধুরী
আসক্ত আগুনের স্বাদ তবু নিত্য জানলার মগজ বড্ড বিনিয়াৎ অলিগলি। রোদখালি কাগজের মৃত পার্ক চুঁইয়ে ট্রিগারে সকাল মাখিয়ে উষ্ণ ভাঁড়ের লাশকোড বেমালুম বেমারি বরফ। মৃত্যুর রঙ সাঁতরালাম নিছকই ব্যালিক ভাবনার নিশাচর নদীটি। সেঁকা চাঁদ আর স্যাঁতসেঁতে পাঁজরার মাটি মৃতদ্বারের অ্যারোফেজ গলা বসে যায় অহরহ জলচিজ : চোরাহিমের কুরিয়ারে তুমি ভুলের বাষ্প গুলে জুবেল আগড় আড়মোড়া ভীড় বাজতে বাজতে ভয় তুলি অপেক্ষার লোকেশ। বদলে আগুন বাতলে বাতাস তুলি হিসাবের খুনি মিউকাস।
কবিতা : উত্তম চৌধুরী
ছায়াবৃত্তে জেগেছে কুসুম
উত্তম চৌধুরী
ছায়াবৃত্তে জেগেছে কুসুম
আমিও জেগে উঠতে চাই,
আমাদের অতিপ্রিয় ঘুম
ছোট্ট হতে হতে বনসাই।
যে আলোকে অন্ধকার আসে
আমি তার প্রথম দোসর,
অপসূর অনুসূর খেলা
চোখ মেলে দেখেন ঈশ্বর।
জলশব্দ বায়ুশব্দে লীন
ডান বাম বৃত্ত সমতল
চোখ মুখ আবর্তিত মুখে,
উল্কাপাতে আলোকিত নদী
পারম্পর্য ধরে ঘণ্টা পল
জানালায় ঝোলে অন্তহীন।
কবিতা : বদরুদ্দোজা শেখু
মুখগুলো
বদরুদ্দোজা শেখু
মুখগুলো ক্ষতবিক্ষত
মুখগুলো ভয়ার্ত সন্ত্রস্ত বিধ্বস্ত
মুখগুলো বিপন্ন আতঙ্কগ্রস্ত
মুখগুলো আর্তনাদ করছে , প্রাণভয়ে
চীৎকার করছে ,আপ্রাণ প্রাণভিক্ষা করছে
মুখগুলো পুড়ে যাচ্ছে
পুড়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি বস্তি বাজার , পুড়ে যাচ্ছে ,জ্বলে'পুড়ে' সব খাক হ'য়ে যাচ্ছে
ভয়ঙ্কর লুঠপাট খুন ধর্ষণ হিংসার অট্টহাসির
ভিতর
মুখগুলো বীভৎস করুণ কদাকার
মুখগুলো নিরাশ্রয়
মুখগুলো নিরপরাধ
মুখগুলো রিক্ত নাচার হতভাগ্য
মুখগুলো মানুষের
মুখগুলো কোনো মুখোশ নয়
মানুষ শুধু মানুষ পুড়ছে
আবালবৃদ্ধবনিতা পুড়ছে
জ্বলে'পুড়ে' ছাই হচ্ছে
পুড়ছে সভ্যতা , পুড়ছে মানবতা
পুড়ছে সম্প্রীতি, পুড়ছে সমাজ !
মুখগুলো ক্যানভাস
সারি সারি শুধু জ্বলন্ত মুখ
কাঁপছে কাঁপছে আর কাঁপছে
দাউ দাউ ক'রে জ্বলছে সংবাদ
যুদ্ধে দাঙ্গায় হিংসায় সন্ত্রাসে
পুড়ছে সভ্যতা, ভয় ও ভিক্ষায়
পুড়ছে মানবতা, দায়হীন
দীক্ষাহীন দাক্ষিণ্যহীন
পুড়ছে না বিবেক খুনে' রাষ্ট্রশক্তির
কিংবা তার খুনে' সাঙাৎকুলের,
ফুলের মতোন মুখগুলো
পুড়ে যাচ্ছে পুড়ে যাচ্ছে পুড়ে যাচ্ছে পুড়ে যাচ্ছে
যার জন্য আদৌ তারা দায়ী নয় ,
ভয় চারিপাশে শুধু দমবন্ধ ভয় - -
কবিতা : আব্দুস সালাম
উদ্বিগ্ন সকাল
আবদুস সালাম
ভাঙা ঘরে চাঁদ উঁকি মারে
রহস্যময়তা ঘিরে নামে বৃষ্টি
হৃদয়ে জমা হয় উদ্বিঘ্ন সকাল
রহস্যময়তা ঘিরে নামে বৃষ্টি
হৃদয়ে জমা হয় উদ্বিঘ্ন সকাল
মন খারাপ তাড়া করে
আমার বাড়ি ঘর আমার নয়
আকাশ ভেঙে পড়ে মাথায়
এদেশ ও নাকি আমার নয়
শরু হয়ে আসে রাস্তা
হিংস্রঃমানুষের আস্ফালনে কাঁপে জন্মভূমি
আকাশ ভেঙে পড়ে মাথায়
এদেশ ও নাকি আমার নয়
শরু হয়ে আসে রাস্তা
হিংস্রঃমানুষের আস্ফালনে কাঁপে জন্মভূমি
নৈতিকতার হাহাকার বাজে সর্বত্র
বেজে ওঠে ধর্মের বিউগল
অসীম পৃথিবীর বদলে যায় ভাষা
বেজে ওঠে ধর্মের বিউগল
অসীম পৃথিবীর বদলে যায় ভাষা
আত্মকেন্দ্রিক কুয়াশা লেপ্টে ধরে জীবনের ঘ্রাণ
পরাজয় মাথা চাড়া দেয় বার বার
পরাজয় মাথা চাড়া দেয় বার বার
নির্বাক পৃথিবী ধর্ম মেখে অদৃশ্য রাস্তায় হাঁটে
কবিতা : বিকাশ চন্দ
হৃদয়ের চুপ কথা
বিকাশ চন্দ
দু'হাতের তালুতে রেখেছি কুঁড়ি মুখ
তখনও রাত্রি আসেনি নীল ঘুম সাথে
জল স্থল জুড়ে তখন ভবঘুরে সন্ধি কাল
এখন অকাল বৈশাখী ধূলো ঝড়
এভাবেই ভিজতে ভিজতে
কখন যেন উঠে আসে আদিম সভ্যতা।
#
পৃথিবীর জন্ম কালই জানে কেবল বৃষ্টির ইতিকথা
কি মায়াবী প্রেম কথা পরকিয়া মুখো মুখি
মুগ্ধতায় প্রাচীন কলাপ হায় বৈশাখী ঝড়
অদ্ভূত ছিল ঠোঁট জুড়ে চুম্বন পিপাসা
সমূহ অস্তিত্ব জুড়ে ভেসে যায় বৃষ্টি জল
হয়তো বা আমার জন্ম কাল ভেসে গেছে কবে
কেবল কিছু সময় এদিক ওদিক
হঠাৎ বিচ্ছিন্ন শরীর হিসেব হীন
রক্ত মাংস জল কাদা মাটি
কোথাও বা আমার চেনা মুখ গুলি বোবা হয়ে গেছে
কেবল চোখগুলো নিষ্পলক পাষান মূর্তি যেন
কিছু থাকে ছদ্মবেশী মানুষ প্রার্থনারত এই পোড়া দেশে।
#
জল নদী সাগর জানে শব্দ উত্তাল কলরোল
সহজাত চুম্বন কাল বারুদ গন্ধী শ্বাস
কেবল শুনি প্রতিধ্বনি পাশাপাশি হৃদয়ের চুপ কথা।
কবিতা : অনিরুদ্ধ সুব্রত
প্রিয় মৌসুমী বায়ু
অনিরুদ্ধ সুব্রত
১
পশ্চিমি ঝঞ্ঝা-ক্ষুব্ধ দিন গুলোর কথা এখন ভুলে যাচ্ছি
পলাশের রক্ত-আগুনের তাপে সেই তো শেষ বার সেঁকে নিয়েছি
বসন্তের বাতাস বরাবর জ্যোস্না-রাতের বাঁশি বেজেছে কতই
মেহগনি সংবেদে ফিরেছে আবার, হিমালয় ছেড়ে গৃহী-সন্ন্যাসীর মতোই
উদাসীন শূন্য চৈত্র-মাঠ আবার ধরেছে বায়না, নিজস্ব ফসল-গর্ভ-গান
দূরে একটি দু'টি খেজুর গাছের হৃদয় আকাশের গায় কাঁটা ফুটিয়ে দেয় ।
২
ভাবছিলাম নাম হোক 'দুপুরবেলা' আমার, বিশেষত এই বয়সে মানায়
শরীরের নাম গ্রীষ্মকাল। ঘেমে নেয়ে কাব্য কি হয়, অস্বস্তির চালসে গায়
ফুটো ফাটা ত্রিপল ঢাকা ঘুন ধরা সেই বাঁশের খুঁটি। চেষ্টা চলে পরিপাটি
তবুও ফাঁটে চাষের মাটি,রসের অভাব,শুকিয়ে আসে গভীর থেকে বুক অবধি।
৩
একটু একটু থমকে বাতাস, অনেকটা শীত শীতল থেকে,ধুলো ধোঁয়ার পথ
কখন দেখি অসহ্য বোধ, গুমোট হয়ে সমস্ত ভাব, মাথায় ওঠে সব উত্তাপ ।
মাঝ দুপুরের আগুনে খাগ দু'চোখ শুধু ধূ ধূ,কাজের মানুষ, মগডালে এক ঘুঘু ।
সহ্য হয় না কঠিন পাচ্য, না-হজম কতই স্বাদ,অসাধ্য সাধ্য করার তবুও সেই সাধ
অনবরত ঘামে ভেজে সহায় যত, ভিজে ওঠে নাক, পিছলে যায় চশমাটা আর
পিছিয়ে পড়ে হাত ।
৪
তবুও বলি ফিরিস্তি এ সব, দুপুরবেলা পাল্টে শরীরের নাম যে গ্রীষ্মকাল।
তাপ সয়ে যাক,বন্ধ বাতাস তাও সয়ে যাক, এখানে জমুক গভীর নিম্নচাপ ।
সকাল ফিরে কী করে পাবে, বাড়ি তোমার নিরক্ষীয়--- বদলে নেবে ?
কোন সকাশে কে-ই বা আছে, জলের কাছে ঘর, এখানে শুধুই বালির ঝড়।
প্রিয় আমার মৌসুমী বায়ু, এই রোদ্দুর এই দুপুরে, এক পশলা বৃষ্টি নামাবে ?
কবিতা : শুধ ব্রত রাউত
কুহুক
শুদ্ধ ব্রত রাউত
যে যার মতো হাসবে
আর যে যার মতো বেরিয়ে যাবে
ব্যক্তিগত গরিমা মকশো করতে
ঢেউ এসে খুলে নেবে পা
তারপর ঢেউয়ের পেছন ছুটে
পায়ের কথা ভুলে তিন/দুই/এক
ফিরে যাবে গৃহহীনতায়
শুধু দেয়াল দিয়ে বেঁধে রাখলেই
শূন্যত্যাগী হয় না সব
ছাদের গায়ে বেজে উঠলেই
পুরনো আওয়াজ নিজের-
বলে মানে না শ্মশান-কোকিল
কিছু কি ছিলো কখনো?
এমন ভাবলেই তো খুলে নিতে হয়
দুর্বোধ্য হরফের ট্রাঙ্ক
কিছু কি বদলেছে আদৌ?
যা ছিলোই না তার গতি কেমন আবার!
রিক্সার চাকা!
চলমান রাস্তা;
পরক্ষণে দেখি সে স্থির আছে আগের মতো!
এ সবই কেবল আবহ বোধয়
যে জামানা পেতেছে যেমন বীর্যের মাদুর!
ঘড়ির দিকে-
তাকাতে ভালো লাগে তাই
দিনরাত মিলিয়ে অন্তত ৩/২/১ বার
কখনো বড় কাটা টা হয়ে ওঠে
ধুসর একটা T-rex
ছোট টা ব্লুয়িশ হামিংবার্ড
এমন করে কোন কিছুই আর আমি হয়ে ওঠে না
কবিতা : নিত্য রঞ্জন মণ্ডল
বৃষ্টি আসা মেঘে
নিত্য রঞ্জন মণ্ডল
সুদূরের চলন্ত ট্রেনে তোমারে দেখেছি
ভালোবাসার মানে এই হয় না কি
সদ্য সকালে ঝুরে পড়া গোলাপের শিশিরে
ভেজা পাপড়ি, শূণ্যতা উঠান ;
কেউ নেই, শূণ্যতার ডাকে
ভাঙা জানলা চৌকাঠ, দু' টি চোখ চেয়ে থাকে ;
বৃষ্টি আসা মেঘে
আমার বিছানার চাদর ভিজে গেছে
রাতের গভীর আঁধারে গায়ে সেই ছেঁড়া কাঁথা
আজ আর গন্ধ পাই না
আমার সেই ভাঙা ঘর নেই
ভাড়া ঘরে থাকি --- কত কথা মুখে মুখে,
ভাড়া দিতে দেরি হলে জীবনের স্রোতে টেনে নিয়ে যায়
বাড়ীর মালিকের মৃত্যুর মত চোখ রাঙানি
আমি শুধু জীবন্ত ভাবে দেখেছি।
কবিতা : অনুপ মণ্ডল
হাওয়া
অনুপ মণ্ডল
।।আফিম-অন্ধকারের আদলেই এখানে সঙ্গম শেখানো হয়।।/অন্ধকারে অন্ধকারে পাথর মসৃণ হয়ে ওঠে/
# # # # # # # # # # # # # # # # # # # # # # #
উল্টোদিকে একটা দুমুখ খোলা পাতি সংসার/১০২ডিগ্রি জ্বর নিয়ে/ল্যাম্পপোস্টে ল্যাম্পপোস্টে কাত হয়ে ঝুলছে/ক্লিনিক্যাল থার্মোমিটার ও বিজ্ঞাপনের নারী/কেবলই দুলছে/
# # # # # # # # # # # # # # # # # # # # # # #
মাঝের রাস্তাটাকে আমরা সংকটকাল বলি/কেউকেউ বলে প্রণবদা বা মদনবাবু কেউ বলে হাওয়া/একটু খুঁড়িয়েখুঁড়িয়ে চলা একটু লব্ধকাম/হাওয়ার ভালো আছে হাওয়া মন্দও হয়/আবহাওয়া দপ্তরের সদর দরজা বন্ধ হয়ে গেলে/যে কোনও দিকেই মুখ করে মোরগ ডেকে উঠতে পারে।
কবিতা: সৌমিত্র চ্যাটার্জী
এখনও পোড়েনি হৃদয়
সৌমিত্র চ্যাটার্জী
আজ বেদনাকে বলছো ধরতে হাত
এখনও চঞ্চল সুমেরুশীর্ষে বরফ কাঁপানো শীতঝড়
এখনও পোড়েনি হৃদয় জুড়ে সব গোলাপের অস্থিমজ্জা
হয়তো ভেঙে যাবে আজ
অনন্ত প্রতীক্ষার চিরুণী সংলাপ
আমাকে হারাতে চাও
তোমার স্পর্শে উদ্দাম ছিল দেহকোষ
রোমকূপে যখন পড়েছে ধারালো তুষারাঘাত
আমাকে ভাসাতে পেরেছো পরিপূর্ণ বিষে
সে কি আমার দোষ
পূর্ণ বাস্পে পরিনত স্মৃতির আঙুররস
ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাও অগোছালো মন ধুপের ধোঁয়ার মত
জানালার নিচে ছাই এর মত
উড়ে বেড়ায় জমকালো শীতাতপ
মুঠো মুঠো তুষার ভরে দিয়েছো লবনাক্ত ফুসফুসে
মেঠো বাতাসের কাছে লিপিবদ্ধ আছে
দূরন্ত সব অভিযোগ...
অনুগল্প : আবদুস সাত্তার বিশ্বাস
বাগদি মেয়ে
আবদুস সাত্তার বিশ্বাসএক
বেগে ট্রেন চলছে।হকারদের চিৎকার চেঁচামেচিও চলছে।একটি হিজড়ে হাত তালি দিয়ে পয়সা আদায় করছে।এই পয়সা দে।এই পয়সা দে।পয়সা যে দিচ্ছে খুশি হয়ে তার গালে চুমো দিচ্ছে।পয়সা যে না দিচ্ছে রেগে গিয়ে তার গালে থাপ্পড় দিচ্ছে।আর যা তা ভাষায় তাকে গালি দিচ্ছে।তবে সবাইকে নয়।যারা বয়সে তরুণ এবং দেখতে সাধারণ চেহারার কেবলমাত্র তাদেরকে। অর্থাৎ মানুষ চিনে চিনে।কোন কোন সময় কারও পকেট থেকে হাত ঢুকিয়ে পয়সা বের করে নিচ্ছে।সে পয়সা আর ফেরত দিচ্ছে না।দেখে দেখে অনেকে বুক পকেটের পয়সা সামলিয়ে রাখছে।সতর্ক হচ্ছে।গেটের ডান দিকে সিটে বাচ্চা কোলে একটি মেয়ে বসে রয়েছে।বাচ্চাটির বয়স আন্দাজ মাস ছয়েকের বেশি হবে না।বাচ্চাটি মেয়েটির কোলে এখন ঘুমাচ্ছে।নিশ্চয় তার পেট ভর্তি আছে বলে ঘুমাচ্ছে।পেট ভর্তি না থাকলে কখনোই এভাবে অর্থাৎ এত শান্ত ভাবে কোন বাচ্চা ঘুমাবে না।এই বাচ্চাটিও ঘুমাত না।অনেক আগেই তার ঘুম ভেঙে যেত।আর মায়ের কোলে সঙ্গে সঙ্গে কান্না জুড়ে দিত।মেয়েটি এখন যেভাবে হিজড়েটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।আর তাকিয়ে তাকিয়ে যেভাবে তার পয়সা আদায় করা দেখছে বাচ্চাটির ঘুম ভেঙে গেলে কখনোই মেয়েটি তা দেখবার সময় পেত না।বাচ্চাটির কান্না থামাতে আর তাকে সামলাতে তাকে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হতো।কারণ পেটে খিদে না পেলে এই ধরনের বাচ্চাদের সচরাচর ঘুম ভাঙে না।সুতরাং তার যখন ঘুম ভাঙবে তখন আমরা ধরে নেব যে তার খিদে পেয়েছে।এ কি!বলতে বলতে তার খিদে পেয়ে গেল!ওই তো তার ঘুম ভেঙে গেছে।কান্না করছে।মেয়েটি তার কান্না থামানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে।তাকে সামলাতে মেয়েটি ওই তো ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।আদর করছে।সোহাগ করছে।"ও ও ও...কি হয়েছে...কি হয়েছে.... দেখি দেখি...ও ও ও...সোনা আমার.... চাঁদ আমার...ও ও ও...!"
কিসে কি!কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।বাচ্চাটির কান্না থামছেনা।বরং আরো জোরে জোরে কাঁদছে।মানুষের যখন খুব খিদে পায় ভালো কথাও যে তার তখন শুনতে ভালো লাগেনা। বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও একই রকম ঘটে।তাদের কান্নার সময় যত বেশি আদর করা যায় কান্না তাদের তত বেশি বৃদ্ধি পায়।কিন্তু তাদের মুখের ভিতর যখন স্তনবৃন্ত ঢুকে দেওয়া হয় কান্না ঠিক থেমে যায়।ফলে মেয়েটি এখন খুব সহজেই অনুমান করে নিল যে,তার বাচ্চার ক্ষুদ্র পেটে খুব খিদে পেয়েছে।তাকে এক্ষুনি দুধ পান করাতে হবে।নাহলে কোন সোহাগেই যে এখন তার কান্না থামবে না।কেঁদেই যাবে।সে কেঁদেই যাবে।
দুই
অতঃপর মেয়েটি যেই দুধ গুলে বাচ্চাটিকে খাওয়াবে ভাবল অমনি তার মনে পড়ে গেল যে,বিরাট ভুল হয়ে গেছে।ট্রেনে উঠার সময় স্টেশনে সে ব্যাগ ভুলে গেছে।সিমেন্টের একটা ঠেস বেঞ্চে বসে বাচ্চাকে সে দুধ গুলে খাওয়ানোর পর ব্যাগটা পাশে রেখেছিল।তারপর ট্রেন চলে এলে তাড়াতাড়ি করে সে ট্রেনে উঠে পড়ে।এবং ব্যাগটা নিতে ভুলে যায়।এখন সেটা মনে পড়ছে।মনে পড়ছে বলে কপালে সে হাত দিল,"হায়!সর্বনাশ হয়ে গেছে।"মেয়েটির পাশে একটি বয়স্কা মেয়ে বসে আছে।পরনে তার সাদা শাড়ি।মেয়েটির 'হায়! সর্বনাশ হয়ে গেছে' শুনে বয়স্কা মেয়েটি তাকে বলল,"মা,তোমার কি সর্বনাশ হয়ে গেছে?"
মেয়েটি বয়স্কা মেয়েটিকে তার সর্বনাশের কথা বলল।বয়স্কা মেয়েটি তার সর্বনাশের কথা শুনে ভীষণ দুঃখ পেল।আর তাই তার মুখ থেকে তখন বেরিয়ে গেল,"ইস্!সত্যিই তো দারুণ সর্বনাশ হয়ে গেছে তোমার।"তারপর বলল,"ব্যাগে নিশ্চয় টাকা ছিল?"
"সে তো ছিলই।"মেয়েটি বলল।
বয়স্কা মেয়েটি তখন বলল,"এতবড় ভুল কেউ করে!"
মেয়েটি বলল,"ভুল কি আমি ইচ্ছা করে করেছি?ভুল হয়ে গেছে তো আমি কি করব বলুন!"
"ব্যাগে তোমার কত টাকা ছিল?"
"তিন হাজার টাকা।আর একটা মোবাইল ছিল।"
শুনে বয়স্কা মেয়েটি "হায় হায়" করে উঠল।ও বলল যে,যে শালা পাবে সে শালা একেবারে বসিয়ে দেবে।তারপর মেয়েটিকে প্রশ্ন করল,"কি বসিয়ে দেবে না?"
মেয়েটি বলল,"দেবেই তো।"বললে পরে বয়স্কা মেয়েটি বলল,"আমার জান বিষিয়ে গেল গো। তোমার জিনিস হারিয়েছে তোমার তো তাহলে জান বিষাবেই।"
মেয়েটি বলল,"টাকা বা মোবাইলের জন্য অত জান বিষাচ্ছে না আমার।আমার জান বিষাচ্ছে বেশি অন্য জিনিসের জন্য।"
বয়স্কা মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে বলল,"তাহলে কি ব্যাগে তোমার সোনাদানা ছিল?"
"না।ওসব কিছু ছিল না।"
"তাহলে মূল্যবান জিনিস আর কি ছিল যে,সেটার জন্য তোমার-----"
মেয়েটি বলল,"বাচ্চার দুধ ছিল।দুধের জন্য আমার বেশি জান বিষাচ্ছে।কেননা টাকা গিয়েছে টাকা আবার আসবে।মোবাইলও যখন তখন আবার কিনতে পারব।কিন্তু বাচ্চার এখন খিদে পেয়েছে।খিদের জ্বালায় কান্না করছে।বাচ্চার কান্না এখন কি দিয়ে থামাব?কান্না করতে করতে বাচ্চার যদি কিছু হয়ে যায় বাচ্চা কি কোথাও আর পাবো?তাই বাচ্চার দুধের জন্যই আমার বেশি জান বিষাচ্ছে।ভগবান যাতে আমার বাচ্চার কিছু না করেন।কিছু না করেন।"
মেয়েটির এই কথা থেকে তার মনের কষ্ট বুঝতে পেরে বয়স্কা মেয়েটি বলল,"ওদিকে তাকাও।দেখো,একটি মেয়ে তার বাচ্চার জন্য দুধ গুলছে।তুমি তার কাছে একবার যাও।গিয়ে তোমার বাচ্চার জন্য একটু দুধ চেয়ে আনো।..."
তিন
বয়স্কা মেয়েটির কথা মতো মেয়েটি তাই করল।তাকিয়ে দেখল,সত্যি সত্যি একটি মেয়ে তার বাচ্চার জন্য দুধ গুলছে।যদিও তার বাচ্চাটি কান্না করছে না।কোলে শান্ত হয়ে বসে রয়েছে। দেখার পর মেয়েটি ওই মেয়েটির কাছে এগিয়ে গেল।যাওয়ার সময় পাশের বয়স্কা মেয়েটিকে বলে গেল যে,তার জায়গাটা সে যেন একটু দেখে। সে একটু ওই মেয়েটির কাছ থেকে আসছে।বয়স্কা মেয়েটি "ঠিক আছে দেখছি,যাও।"বলে মেয়েটিকে পাঠাল।
মেয়েটি ওই মেয়েটির কাছে গেল।গিয়ে দাঁড়ানোর পর তাকে বলল,"দিদি,আমার বাচ্চাটার জন্য একটু দুধ দিন না!"কাতর প্রার্থনা করল।
মেয়েটির প্রার্থনা শুনে ওই মেয়েটি তার দিকে চোখ তুলে শুধু একবার তাকাল।কিন্তু কোন উক্তি টুক্তি করল না।
না করলে মেয়েটি ফের বলল,"দিদি,একটু দুধ দিন না!"
কিন্তু ওই মেয়েটি তার কথা শুনল না।না শুনলে মেয়েটি তখন বলল,"বাচ্চাটার খুব খিদে পেয়েছে।খিদের জ্বালায় কান্না করছে।এত যে সোহাগ করছি তা-ও থামছে না।দেখতেই পাচ্ছেন।তাই বলছি,একটু দুধ দিন না!"
দুধ গুলতে গুলতে ওই মেয়েটি এবার বলল,"তোমার বাচ্চার খিদে পেয়েছে তো আমি কি করব শুনি!"তারপর বলল,"খিদে পেয়েছে দুধ খাওয়াও। আমাকে তার কি বলছ?"
মেয়েটি বলল,"আমার কাছে দুধ নেই।আপনি একটু দুধ দিন না!"
ওই মেয়েটি তার উত্তরে বলল,"কোলে বাচ্চা আছে।বাচ্চার দুধ নেই কেন?"
মেয়েটি বলল,"বাচ্চার দুধ,একটা মোবাইল ফোন ও তিন হাজার টাকা একটা ব্যাগে রাখা ছিল।ব্যাগটা স্টেশনে ভুলে গেছি।"
"ভালো করেছ।তা আমি কি করব?"ওই মেয়েটি বলল।
"আপনার বাচ্চার জন্য তো দুধ গুলছেন। ওতে থেকে একটু দুধ দিন না!"
সঙ্গে সঙ্গে ওই মেয়েটি বলে উঠল,"তুমি কি বললে!আমার বাচ্চার দুধ তোমার বাচ্চাকে দেব! নো,নেভার!"
মেয়েটি অমনি তার হাতে ধরতে গেল ,"আপনার হাতে ধরছি দিদি,একটু দুধ দিন!একটু দুধ দিন!একটু দুধ দিলে আপনার বাচ্চার দুধ কম পড়বেনা।আমি জল মিশিয়ে খাইয়ে দেব।"
ওই মেয়েটির পাষাণ হৃদয় তবু মেয়েটির প্রতি গলল না।বরং সে হাত সরিয়ে নিল।নিয়ে বলল,"না,তুমি আমার হাত ধরবে না।হাত ধরবে না বলছি।"সে মেয়েটিকে কোন ভাবেই তার হাত ধরতে দিল না।
মেয়েটি এরপর আর তার হাত ধরবার চেষ্টা করল না।বলল,"বেশ,আপনার হাত ধরব না। আপনি শুধু একটু দুধ দিন!একটু দুধ দিন!"
ওই মেয়েটি এবার মেয়েটির প্রতি ভীষণ বিরক্ত হয়ে রেগে গিয়ে বলল,"বারবার তুমি কি ধরেছ গো,একটু দুধ দিন,একটু দুধ দিন !দেবনা বললে শুনতে পাও না!"
মেয়েটি তবু আরেকবার বলল,"একটু দুধ দিন না!"
না,ওই মেয়েটি এবার আর ধৈর্য ধরতে পারল না।না পেরে সে মেয়েটিকে কষে ধমক মারল,"সাট আপ!"তারপর চোখ রাঙিয়ে বলল,"দুধ দেব না বললে শুনতে পাও না?কেন,তোমার বুকের দুধ খাওয়াতে পারছ না?"
মেয়েটি উত্তরে বলল,"আমার বুকের দুধ পান করাই না।"
"কেন পান করাও না?"
মেয়েটি বলল,"সমস্যা আছে।"
"কি সমস্যা আছে?মা বাচ্চাকে দুধ পান করাবে এতে আবার সমস্যা কি আছে?"
মেয়েটি বলল,"সমস্যা আছে।"
ওই মেয়েটি তখন বলল যে,সে এই প্রথম শুনছে যে,বাচ্চাকে স্তন পান করাতে সমস্যা আছে।আগে সে কখনো কোন মায়ের মুখে এমন কথা শুনেনি।
মেয়েটি বলল,"সে আপনি না শুনতেই পারেন।আমার সমস্যা আছে তাই সমস্যার কথা বললাম।"
ওই মেয়েটি এরপর যা বলল তা হল ,"তোমার সমস্যা টমস্যা কিছু নেই।আসলে তুমি বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করাতে চাও না।"
মেয়েটি তার মৃদু প্রতিবাদ করল,"এ আপনি কি বলছেন দিদি!সমস্যা না থাকলে বাচ্চাকে দুধ পান করাব না তাই কি হয়?ভগবান তো মেয়েদের স্তন দুটো বাচ্চাকে পান করানোর জন্যই দিয়েছেন।তাছাড়া এ দুটোর আর কি কাজ আছে আমাকে বলতে পারেন?"
ওই মেয়েটি অমনি বলে দিল,"পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য অনেক মেয়ে আছে বাচ্চাকে স্তন পান করালে স্তনের সাইজ নষ্ট হয়ে যাবে বলে স্তন পান করায় না।তুমিও যে তাদের দলে পড়ছ না তা বুঝব কি করে?"
ট্রেন ভর্তি মানুষের মধ্যে এতবড় খারাপ কথা বলল ওই মেয়েটি তাকে!দুধ দেবেনা দেবেনা। কিন্তু এতবড় খারাপ কথা বলার সে কে?এ অধিকার সে পেলই বা কোথায়?অতএব মেয়েটির চরম রাগ হয়ে গেল তার প্রতি।রাগের চোটে সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না।ফলে অমনি সে ওই মেয়েটির গালে একটি শব্দ চড় বসিয়ে দিল,"খানকি!"যে চড়ে শব্দ হয় তাকে বলে শব্দ চড়।বসিয়ে দিয়ে তার গলাটা এবার চেপে ধরল,"বল,এরকম কথা কোন মেয়েকে আর কোনদিন বলবি?"
ওই মেয়েটির পাশে একটি ভদ্রমহিলা বসে আছে।সে মেয়েটিকে ধরে ছাড়িয়ে দিল,"আরে,এ কি করছ!ট্রেনের ভিতর কেউ মারামারি করে?"
মেয়েটি ভদ্রমহিলাটিকে তখন বলল,"আপনি তো বসে আছেন।সব দেখছেন এবং শুনছেন। আপনি বলুন তো,আমি ওকে কোন দোষের কথা বলেছি কি!আমি আমার ক্ষুধার্ত শিশুটির জন্য শুধু একটু দুধ চেয়েছি।আর ও আমাকে ফট করে অমন কথা বলে দিল!আমার কি মানসম্মান নেই!মেরে দাঁত মুখ ভেঙে দেব না!"
ওই মেয়েটি এবার তাকে ইংরেজিতে গালি দিল,"প্রস্টিটিউট!এবার মারতে আয় দেখি।যদি তোর হাত দুটো দুমড়ে মুচড়ে না দিই।"
তার ওই কথা শুনে মেয়েটি তখন ভীষণ ক্রোধে তার দিকে আবার এগিয়ে যেতে গেল,"তোকে এই ট্রেনের মধ্যেই মেরে সাট করব।দেখি তুই আমার কি করতে পারিস।"
সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রমহিলাটি তাকে ফের ধরে নিল। তার কাছে তাকে যেতে দিল না।নিয়ে ওই মেয়েটিকে বকতে লাগল,"তুমি চুপ করতে পারছ না!"
ওই মেয়েটি তার উত্তরে ভদ্রমহিলাটিকে বলল,"কেন চুপ করব?দেখলেন না,প্রস্টিটিউটটি কেমন করে আমাকে মেরে গেল?"
"কথাটি বলা যে তোমার অন্যায় হয়েছে।" ভদ্রমহিলাটি তাকে তখন বলল।
"আমার কিছু অন্যায় হয়নি।এরা এই ধরনেরই মেয়ে,বুঝলেন?আমরা মানুষ দেখলে চিনতে পারি।"
মেয়েটি তখন ভদ্রমহিলাটিকে বলল,"ম্যাডাম,আপনি ওকে সাবধান করে দিন!এবং চুপ করতে বলুন!নাহলে কিন্তু----"
ভদ্রমহিলাটি ওই মেয়েটিকে তখন বলল,"তুমি চুপ করো!"
সে চুপ করল না।বরং সরাসরি মেয়েটিকে সে বলল,"আমি চুপ করব না।তার কি বলছিস,প্রস্টিটিউট!"
সেই তখন থেকে সে মেয়েটিকে ইংরেজিতে গালি দিয়েই চলেছে।কিন্তু মেয়েটি একবারও একটি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেনি।এবার সে ব্যবহার করল,"prostitute!I am not prostitute.I am a good-charactered woman.But you are not.So your mother is prostitute.your father is prostitute.And your brother and sister prostitute।..."অনবরত সে ইংরেজিতে গালি দিয়েই চলল।তার ইংরেজি গালির কাছে সে দাঁড়াতে পারল না।সাধারণ চেহারার এবং সাধারণ পোশাকের মেয়েটির মুখে ইংরেজি গালি শুনে ওই মেয়েটি এবার আপনি থেমে গেল।তাকে এবার আর কাউকে থামতে বলতে হল না।যদিও থামবার আগে সে একটি মৃদু প্রতিবাদ করল,"খবরদার! তুই আমাকে যা খুশি বল।কিন্তু আমার মা-বাবা এবং দাদা-দিদিকে এর মধ্যে একদম টেনে আনবি না,বলে দিলাম।"
সাধারণ চেহারার এবং সাধারণ পোশাকের মধ্যেও যে অনেক আগুন লুকানো থাকে মেয়েটি তার প্রমাণ দিল।
চার
বাচ্চাটি মেয়েটির কোলে এখনও কাঁদছে। এখনও তার কান্না থামেনি।কারণ তার পেটে যে এখনো খাবার পড়েনি।সুতরাং বাচ্চাটির কান্না দেখে ভদ্রমহিলাটি বলল,"ইস্,বাচ্চাটির খুব খিদে পেয়েছে!"
"হ্যাঁ,খুব খিদে পেয়েছে।তা-ও দেখুন,বাচ্চাকে স্তন পান করাতে পারছিনা।কারণ----"
"কারণ?"
"কারণ আমার স্তন পান করানো বারণ আছে। ডাক্তার বাবু বারণ করেছেন।ডাক্তার বাবুর পরামর্শ মতো তাই প্রথম থেকেই কৌটোর দুধ খাওয়াচ্ছি।"
"ডাক্তার বাবু বারণ করেছেন কেন?"
মেয়েটি তখন বলল,"এর আগে আমার চারটে সন্তান হয়ে মারা গেছে।তা-ও আবার সব গুলোই কচি অবস্থায়।বারবার এরকম কেন হচ্ছে?কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে আমার স্তনের দোষ আছে।ডাক্তার বাবু তাই কঠিন ভাবে বারণ করে দিয়েছেন,আমি যাতে কখনোই বাচ্চাকে স্তন পান না করাই।তাহলে বাচ্চা মারা যাবে।আগের বাচ্চা গুলো যেভাবে মারা গেছে।তাই বাচ্চাকে স্তন পান করাই না।কিন্তু দেখুন,মানুষ সেটা না জেনে বুঝে অন্য রকম মন্তব্য করে মনে কষ্ট দিচ্ছে।"
ভদ্রমহিলাটি বলল,"তোমার সমস্যা আমি ঠিক বুঝেতে পেরেছি।কিন্তু তুমি এখন কি করবে?"
"সেটাই তো ভাবছি,আমি এখন কি করব?"
একটু ভেবে ভদ্রমহিলাটি বলল,"তুমি একটা কাজ করো।এদিক ওদিক একটু ঘুরে দেখো। কারো না কারো কাছে একটু দুধ ঠিকই পেয়ে যাবে।নাহলে বাচ্চাটা যেভাবে কান্না করছে মারা যাবে তো।"
সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটির চোখে জল চলে এল,"না,অমন কথা বলবেন না।"তারপর বাচ্চাটিকে বুকে করে মেয়েটি এবার এদিক ওদিক ঘুরে দেখতে লাগল কার কোলে দুধের বাচ্চা রয়েছে।কে বাচ্চাকে দুগ্ধ পান করাচ্ছে।যার কোলে দুধের বাচ্চা দেখতে পেল তার কাছেই একটু দুধের জন্য ছুটে গেল।কিন্তু কারও কাছেই একটু দুধ মেয়েটি পেল না।দুধ নেই বলে দুধ থেকেও কেউ দুধ দিল না।ক্রন্দনরত শিশুটিকে বুকে করে মেয়েটি সারা বগি ঘুরল।কোথাও একটু দুধ না পেয়ে মেয়েটি তার জায়গায় ফিরে এসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল,"ঠাকুর!তুমি করুণা করো ঠাকুর!আমার বাচ্চাটার তুমি বাঁচিয়ে দাও।একটু দুধ কোথাও পেলাম না।কেউ দিল না।একটু দুধের তুমি ব্যবস্থা করে দাও,ঠাকুর!"
বাচ্চাটি তখন কান্না করতে করতে 'খক খক' করে উঠল।মেয়েটি তখন জোর চিৎকারে কান্না করে উঠল,"ঠাকুর র র র..!"
এরপর বাচ্চাটির খক খক বন্ধ হলে সেই বয়স্কা মেয়েটি তাকে বলল,"এতবড় বগিতে কোথাও একটু দুধ পেলে না?"
"না।কোথাও একটু দুধ পেলাম না।দুধ থেকেও কেউ একটু দুধ দিল না আমার বাচ্চার জন্য।" কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটি বলল।
"আশ্চর্য!কেউ একটু দুধ দিল না!এরা কি সব মানুষ!না এরা কেউ মানুষ নয়।সব মানুষের মতো। কারণ মানুষ কোনদিন এত কঠোর হতে পারে না।..."বলতে বলতে বয়স্কা মেয়েটি ভগবানকে ডাকল,"ভগবান,তুমি এই মানুষ রূপীদের উপর অভিশাপ বর্ষণ করো।দুধ থেকেও যারা দুধের এই ক্ষুধার্ত শিশুটিকে একটু দুধ দিল না তুমি তাদের উপর অভিশাপ বর্ষণ করো।কখনো তাদের উপর করুণা বর্ষণ করোনা।কখনো তাদের উপর..."অভিশাপ দিতে দিতে বয়স্কা মেয়েটি উঠে দাঁড়াল।ক্রন্দনরত বাচ্চাটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।দিয়ে মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলল,"মা,তোমরা থাকো।কোন চিন্তা করোনা।ভগবান আছেন।উনি নিশ্চয় তোমার ছেলের ক্ষুধা নিবারণ করবেন।"
মেয়েটি তখন তাকে জিজ্ঞেস করল,"আপনি কি নেমে যাবেন নাকি?"
বয়স্কা মেয়েটি বলল,"হ্যাঁ,মা।স্টেশনে ট্রেন ঢুকছে।আমি নেমে যাবো।"
মেয়েটি তখন তাকে বলল,"আমার বাচ্চাকে আশির্বাদ করুন!"
বয়স্কা মেয়েটি আশির্বাদ করল তৎক্ষণাৎ,"ভগবান নিশ্চয় তোমার বাচ্চার প্রতি সহায় হবেন।নিশ্চয় তিনি তোমার বাচ্চাকে দীর্ঘজীবী করবেন।"
তার আশীর্বাদে সন্তুষ্ট হয়ে মেয়েটি বলল,"ভগবান আপনার মঙ্গল করুন!"
"গাড়ি ঢুকে গেছে,মা।আমি নেমে যাচ্ছি।"
"ঠিক আছে,যান।"
পাঁচ
বয়স্কা মেয়েটি নেমে যাওয়ার পর ওই সিটটা এখন খালি হয়ে গেল।কিন্তু খালি থাকল না। তক্ষুনি একটি মেয়ে বসে গেল।মেয়েটি দেখতে সাঁওতাল মেয়ের মতো একেবারে কালো কুচ্ছিত। মেয়েটির এক হাতে একটি ভারি ব্যাগ ধরা আছে। আর এক হাতে বুকের সঙ্গে একটি বাচ্চা ধরা আছে।সিটে বসার আগে সে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল,"দিদি,এখানে কেউ আছে?"মেয়েটি মাত্র এক পলক তার দিকে তাকিয়ে দেখে বলল,"কেউ নেই।বসো।"
মেয়েটি অমনি সিটে বসে গেল।বসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুকের বাচ্চাটিকে সে স্তন পান করাতে লাগল।স্তন পান করানোর সময় কাপড় দিয়ে নিজের বুক ভালো করে ঢেকে নিল।যাতে তার স্তন পান করানো কেউ দেখতে না পায়।পান করাতে করাতে একটি স্তন পান করানো হয়েছে ওইসময় মেয়েটির বাচ্চাটি ফের খক খক করে উঠল। আগের বারের মতো মেয়েটি তখন আবারও কেঁদে উঠে ঠাকুরকে ডাকল,"ঠাকুর র র র...!"
কালো মেয়েটি এবার তার বাচ্চার মুখ থেকে তাড়াতাড়ি করে স্তন ছাড়িয়ে নিয়ে মেয়েটির প্রতি ব্যস্ত হয়ে পড়ল,"আপনার বাচ্চার কি হয়েছে ,দিদি?"
মেয়েটি ক্ষোভে,দুঃখে কোন কথা বলল না। তার চোখ থেকে শুধু জল ঝরে পড়ল।
মেয়েটি কথা না বললে পরে কালো মেয়েটি ফের তাকে জিজ্ঞেস করল,"আপনার বাচ্চার কি হয়েছে,দিদি?"
মেয়েটি বলল,"শুনে কি করবে?"
"বলুন না,শুনি!"
"শুনবে তো শোনো তাহলে।"মেয়েটি পুরো ঘটনাটা কালো মেয়েটিকে শোনাল।শোনার পর কালো মেয়েটি বলল,"আমি যদি আপনার বাচ্চাকে স্তন পান করাই আপনার কোন অসুবিধা আছে?আমার স্তনের কোন দোষ নেই।"
মেয়েটি চোখ মুছে বলল,"কোন অসুবিধা নেই। তুমি আমার বাচ্চাকে তোমার স্তন পান করাও।"
কালো মেয়েটি তখন বলল,"জাতে আমি বাগদি।বাগদি মেয়ের স্তন পান করলে আপনার বাচ্চার জাত যাবেনা তো?"
মেয়েটি বলল,"না,জাত যাবে না।জাত যাবে কেন?তুমিও মা আমিও মা।তুমিও মেয়ে আমিও মেয়ে।তুমিও হিন্দু আমিও হিন্দু।তুমিও ঠাকুরের পুজো করো আমিও ঠাকুরের পুজো করি।জাত যাবেনা।তাছাড়া আমার কাছে এখন জাত বাঁচানোর চাইতে আমার বাচ্চার জান বাঁচানো অনেক বেশি জরুরি।তুমি আমার বাচ্চাকে স্তন পান করাও,বোন।"
আর একটুও দেরি করল না কালো মেয়েটি। সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাটিকে সে তার কোলে চাইল,"বাচ্চাটি আমার কোলে দিন!"
মেয়েটি বাচ্চাটি তার কোলে দিল,"নাও বোন,তাড়াতাড়ি তোমার স্তন পান করাও।"
কালো মেয়েটি এবার বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে স্তন পান করাতে লাগল।যে স্তনটা তার বাচ্চাকে পান করানো হয়নি।কিন্তু এবার সে কাপড় দিয়ে তার বুক ঢাকল না।সবাইকে দেখিয়ে প্রকাশ্যে স্তন পান করাল।তাদেরকে দেখাল,দেখ।তোরা একটু দুধ দিস নি যে বাচ্চাটিকে আমি তাকে কেমন করে স্তন পান করাচ্ছি।তাদের চরম লজ্জা দিল।
পুনশ্চঃবাচ্চাটির এরপর আপনি কান্না থেমে গেল।সে আনন্দে হাসতে লাগল।বাচ্চার হাসিতে বাচ্চার মা মেয়েটিও হাসল।স্তন পান করালো যে সেই কালো মেয়েটিও।
অনুগল্প : নিখিল মিত্র ঠাকুর
সত্যই সেলুকাশ বিচিত্র এই দেশ
নিখিল মিত্র ঠাকুর
আমাদের কত যে মানুষ রাস্তা ঘাটে, ফুটপাতে, রেল স্টেশনের খোলা প্রান্তরে শুয়ে তার সঠিক গননা হিসাব সরকারের কাছেও নেই। কারো বস্ত্র একে বারেই নেই দেহে, কারো কারো লজ্জা ঢাকার মতো বস্ত্র টুকু আছে। সারাদিনে তারা যে কতো মানুষকে দাও দাও করে চেয়ে থাকে নিজেরাও দিনের শেষে হিসেব মেলাতে পারে না।
অধিকাংশ মানুষ কপালে হাত ঠেকিয়ে চলে যায়, কেউ কেউ মুখ খেচিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে। ভালো কেউ নেই, ভালো কেউ তাদের বাসে না। বোধহয় তাদের জীবন এই পথেয় নির্ধারিত।
কিন্তু আমরা যদি ভেবে দেখি তাহলে খুব সহজে সমস্যা সমাধান করা যায়। আমাদের দেশের লোক সংখ্যা একশো ত্রিশ কোটী। অথচ নিঃসম্বল মানুষদের সংখ্যা খুব বেশি হলে দুই থেকে তিন কোটী হবে। ব্যাপারটা আমাদেরকে পাচজনকে হয়তো তাদের একজনের দায়িত্ব নিতে হবে। খুব সহজেই এটা পালন করা যায়।
আজকাল কিছু সেচ্ছাসেবী সংগঠন এই সব হতভাগ্য মানুষদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র বিতড়নের ব্যবস্থা করতে শুরু করেছে। এটা যে একটা শুভ প্রচেষ্টা সে বিষয়ে কারো কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। কিন্তু এই প্রচেষ্টা প্রয়োজনের বেশ অপ্রতুল। আরো অনেক মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।
আমরা ভারতীয়রা জন্মগত ভাবে উদার। আমরা লুটেরা হুন, বর্গী, পাঠানদের বুকে টেনে নিয়েছি,আমরা অত্যাচারী ইংরেজদের বুকে টেনে নিয়ে শত শত বৎসর দেশ লুট করতে সাহায্য করেছি।
আমি এখন বেশ কিছুদিন রয়েছি কোটা শহরে। সকালে একটু শীত শীত ভাবটা কমলে প্রতিদিন বিভিন্ন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন বেড়াতে গিয়ে দেখি বিভিন্ন মানুষ দামী গাড়ির পিছনে সবুজ ঘাস নিয়ে রাস্তায় যত জায়গায় গোরু দেখতে পাচ্ছে সেখানে সেখানে দাড়িয়ে ঘাস খেতে দিয়ে যাচ্ছে। গোরু গুলো সকালে এত খাবার পাচ্ছে যে তাদের মাঠে না গেলেও সুন্দর সারাদিন চলে যাবে।
গোরু গুলোকে খাবার না দিলেও তারা মালিকের কাছে খাবার পাবেই। কিছু মানুষের মালিক খুব নিষ্ঠুর। তিনি প্রক্ষিপ্ত করার পর ভালো থাকার পথের সন্ধান সন্তানদের দেন না। যাইহোক, গোরুকে খাবার দিলে বেশি পুণ্য হয়, না নিঃস্ব মানুষদের খাবার দিলে বেশি পুণ্য হয় তা আমার জানা নেই। কিন্তু এটা জানি পথ মানুষেরা এটা দেখলে বলবে মানুষ না হয়ে গোরু হলে ভালো হতাম। আমার গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের একটা কথা মনে পড়ছে " সত্যই সেলুকাশ বিচিত্র এই দেশ"।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)