সোমবার, ৩০ মার্চ, ২০২০

অনুগল্প : আবদুস সাত্তার বিশ্বাস



                             বাগদি মেয়ে

                                      আবদুস সাত্তার বিশ্বাস
                       
                              

                                                 এক

 বেগে ট্রেন চলছে।হকারদের চিৎকার চেঁচামেচিও চলছে।একটি হিজড়ে হাত তালি দিয়ে পয়সা আদায় করছে।এই পয়সা দে।এই পয়সা দে।পয়সা যে দিচ্ছে খুশি হয়ে তার গালে চুমো দিচ্ছে।পয়সা যে না দিচ্ছে রেগে গিয়ে তার গালে থাপ্পড় দিচ্ছে।আর যা তা ভাষায় তাকে গালি দিচ্ছে।তবে সবাইকে নয়।যারা বয়সে তরুণ এবং দেখতে সাধারণ চেহারার কেবলমাত্র তাদেরকে। অর্থাৎ মানুষ চিনে চিনে।কোন কোন সময় কারও পকেট থেকে হাত ঢুকিয়ে পয়সা বের করে নিচ্ছে।সে পয়সা আর ফেরত দিচ্ছে না।দেখে দেখে অনেকে বুক পকেটের পয়সা সামলিয়ে রাখছে।সতর্ক হচ্ছে।
     গেটের ডান দিকে সিটে বাচ্চা কোলে একটি মেয়ে বসে রয়েছে।বাচ্চাটির বয়স আন্দাজ মাস ছয়েকের বেশি হবে না।বাচ্চাটি মেয়েটির কোলে এখন ঘুমাচ্ছে।নিশ্চয় তার পেট ভর্তি আছে বলে ঘুমাচ্ছে।পেট ভর্তি না থাকলে কখনোই এভাবে অর্থাৎ এত শান্ত ভাবে কোন বাচ্চা ঘুমাবে না।এই বাচ্চাটিও ঘুমাত না।অনেক আগেই তার ঘুম ভেঙে যেত।আর মায়ের কোলে সঙ্গে সঙ্গে কান্না জুড়ে দিত।মেয়েটি এখন যেভাবে হিজড়েটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।আর তাকিয়ে তাকিয়ে যেভাবে তার পয়সা আদায় করা দেখছে বাচ্চাটির ঘুম ভেঙে গেলে কখনোই মেয়েটি তা দেখবার সময় পেত না।বাচ্চাটির কান্না থামাতে আর তাকে সামলাতে তাকে ব‍্যস্ত হয়ে পড়তে হতো।কারণ পেটে খিদে না পেলে এই ধরনের বাচ্চাদের সচরাচর ঘুম ভাঙে না।সুতরাং তার যখন ঘুম ভাঙবে তখন আমরা ধরে নেব যে তার খিদে পেয়েছে।এ কি!বলতে বলতে তার খিদে পেয়ে গেল!ওই তো তার ঘুম ভেঙে গেছে।কান্না করছে।মেয়েটি তার কান্না থামানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে।তাকে সামলাতে মেয়েটি ওই তো ব‍্যস্ত হয়ে পড়েছে।আদর করছে।সোহাগ করছে।"ও ও ও...কি হয়েছে...কি হয়েছে.... দেখি দেখি...ও ও ও...সোনা আমার.... চাঁদ আমার...ও ও ও...!"
      কিসে কি!কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।বাচ্চাটির কান্না থামছেনা।বরং আরো জোরে জোরে কাঁদছে।মানুষের যখন খুব খিদে পায় ভালো কথাও যে তার তখন শুনতে ভালো লাগেনা। বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও একই রকম ঘটে।তাদের কান্নার সময় যত বেশি আদর করা যায় কান্না তাদের তত বেশি বৃদ্ধি পায়।কিন্তু তাদের মুখের ভিতর যখন স্তনবৃন্ত ঢুকে দেওয়া হয় কান্না ঠিক থেমে যায়।ফলে মেয়েটি এখন খুব সহজেই অনুমান করে নিল যে,তার বাচ্চার ক্ষুদ্র পেটে খুব খিদে পেয়েছে।তাকে এক্ষুনি দুধ পান করাতে হবে।নাহলে কোন সোহাগেই যে এখন তার কান্না থামবে না।কেঁদেই যাবে।সে কেঁদেই যাবে।


                                         দুই

 অতঃপর মেয়েটি যেই দুধ গুলে বাচ্চাটিকে খাওয়াবে ভাবল অমনি তার মনে পড়ে গেল যে,বিরাট ভুল হয়ে গেছে।ট্রেনে উঠার সময় স্টেশনে সে ব‍্যাগ ভুলে গেছে।সিমেন্টের একটা ঠেস বেঞ্চে বসে বাচ্চাকে সে দুধ গুলে খাওয়ানোর পর ব‍্যাগটা পাশে রেখেছিল।তারপর ট্রেন চলে এলে তাড়াতাড়ি করে সে ট্রেনে উঠে পড়ে।এবং ব‍্যাগটা নিতে ভুলে যায়।এখন সেটা মনে পড়ছে।মনে পড়ছে বলে কপালে সে হাত দিল,"হায়!সর্বনাশ হয়ে গেছে।"
      মেয়েটির পাশে একটি বয়স্কা মেয়ে বসে আছে।পরনে তার সাদা শাড়ি।মেয়েটির 'হায়! সর্বনাশ হয়ে গেছে' শুনে বয়স্কা মেয়েটি তাকে বলল,"মা,তোমার কি সর্বনাশ হয়ে গেছে?"
      মেয়েটি বয়স্কা মেয়েটিকে তার সর্বনাশের কথা বলল।বয়স্কা মেয়েটি তার সর্বনাশের কথা শুনে  ভীষণ দুঃখ পেল।আর তাই তার মুখ থেকে তখন বেরিয়ে গেল,"ইস্!সত্যিই তো দারুণ সর্বনাশ হয়ে গেছে তোমার।"তারপর বলল,"ব‍্যাগে নিশ্চয় টাকা ছিল?"
      "সে তো ছিলই।"মেয়েটি বলল।
      বয়স্কা মেয়েটি তখন বলল,"এতবড় ভুল কেউ করে!"
      মেয়েটি বলল,"ভুল কি আমি ইচ্ছা করে করেছি?ভুল হয়ে গেছে তো আমি কি করব বলুন!"
       "ব‍্যাগে তোমার কত টাকা ছিল?"
       "তিন হাজার টাকা।আর একটা মোবাইল ছিল।"
       শুনে বয়স্কা মেয়েটি "হায় হায়" করে উঠল।ও বলল যে,যে শালা পাবে সে শালা একেবারে বসিয়ে দেবে।তারপর মেয়েটিকে প্রশ্ন করল,"কি বসিয়ে দেবে না?"
      মেয়েটি বলল,"দেবেই তো।"বললে পরে বয়স্কা মেয়েটি বলল,"আমার জান বিষিয়ে গেল গো। তোমার জিনিস হারিয়েছে তোমার তো তাহলে জান বিষাবেই।"
      মেয়েটি বলল,"টাকা বা মোবাইলের জন্য অত জান বিষাচ্ছে না আমার।আমার জান বিষাচ্ছে বেশি অন্য জিনিসের জন্য।"
      বয়স্কা মেয়েটি  সঙ্গে সঙ্গে বলল,"তাহলে কি ব‍্যাগে তোমার সোনাদানা ছিল?"
       "না।ওসব কিছু ছিল না।"
       "তাহলে মূল্যবান জিনিস আর কি ছিল যে,সেটার জন্য তোমার-----"
       মেয়েটি বলল,"বাচ্চার দুধ ছিল।দুধের জন্য আমার বেশি জান বিষাচ্ছে।কেননা টাকা গিয়েছে টাকা আবার আসবে।মোবাইলও যখন তখন আবার কিনতে পারব।কিন্তু বাচ্চার এখন খিদে পেয়েছে।খিদের জ্বালায় কান্না করছে।বাচ্চার কান্না এখন কি দিয়ে থামাব?কান্না করতে করতে বাচ্চার যদি কিছু হয়ে যায় বাচ্চা কি কোথাও আর পাবো?তাই বাচ্চার দুধের জন‍্যই আমার বেশি জান বিষাচ্ছে।ভগবান যাতে আমার বাচ্চার কিছু না করেন।কিছু না করেন।"
      মেয়েটির এই কথা থেকে তার মনের কষ্ট বুঝতে পেরে বয়স্কা মেয়েটি বলল,"ওদিকে তাকাও।দেখো,একটি মেয়ে তার বাচ্চার জন্য দুধ গুলছে।তুমি তার কাছে একবার যাও।গিয়ে তোমার বাচ্চার জন্য একটু দুধ চেয়ে আনো।..."

    

                                              তিন

  বয়স্কা মেয়েটির কথা মতো মেয়েটি তাই করল।তাকিয়ে দেখল,সত্যি সত্যি একটি মেয়ে তার বাচ্চার জন্য দুধ গুলছে।যদিও তার বাচ্চাটি কান্না করছে না।কোলে শান্ত হয়ে বসে রয়েছে। দেখার পর মেয়েটি ওই মেয়েটির কাছে এগিয়ে গেল।যাওয়ার সময় পাশের বয়স্কা মেয়েটিকে বলে গেল যে,তার জায়গাটা সে যেন একটু দেখে। সে একটু ওই মেয়েটির কাছ থেকে আসছে।
      বয়স্কা মেয়েটি "ঠিক আছে দেখছি,যাও।"বলে মেয়েটিকে পাঠাল।
       মেয়েটি ওই মেয়েটির কাছে গেল।গিয়ে দাঁড়ানোর পর তাকে বলল,"দিদি,আমার বাচ্চাটার জন্য একটু দুধ দিন না!"কাতর প্রার্থনা করল।
      মেয়েটির প্রার্থনা শুনে ওই মেয়েটি তার দিকে চোখ তুলে শুধু একবার তাকাল।কিন্তু কোন উক্তি টুক্তি করল না।
        না করলে মেয়েটি ফের বলল,"দিদি,একটু দুধ দিন না!"
       কিন্তু ওই মেয়েটি তার কথা শুনল না।না শুনলে মেয়েটি তখন বলল,"বাচ্চাটার খুব খিদে পেয়েছে।খিদের জ্বালায় কান্না করছে।এত যে সোহাগ করছি তা-ও থামছে না।দেখতেই পাচ্ছেন।তাই বলছি,একটু দুধ দিন না!"
       দুধ গুলতে গুলতে ওই মেয়েটি এবার বলল,"তোমার বাচ্চার খিদে পেয়েছে তো আমি কি করব শুনি!"তারপর বলল,"খিদে পেয়েছে দুধ খাওয়াও। আমাকে তার কি বলছ?"
      মেয়েটি বলল,"আমার কাছে দুধ নেই।আপনি একটু দুধ দিন না!"
      ওই মেয়েটি তার উত্তরে বলল,"কোলে বাচ্চা আছে।বাচ্চার দুধ নেই কেন?" 
       মেয়েটি বলল,"বাচ্চার দুধ,একটা মোবাইল ফোন ও তিন হাজার টাকা একটা ব‍্যাগে রাখা ছিল।ব‍্যাগটা স্টেশনে ভুলে গেছি।"
      "ভালো করেছ।তা আমি কি করব?"ওই মেয়েটি বলল।
      "আপনার বাচ্চার জন্য তো দুধ গুলছেন। ওতে থেকে একটু দুধ দিন না!"
       সঙ্গে সঙ্গে ওই মেয়েটি বলে উঠল,"তুমি কি বললে!আমার বাচ্চার দুধ তোমার বাচ্চাকে দেব! নো,নেভার!"
       মেয়েটি অমনি তার হাতে ধরতে গেল ,"আপনার হাতে ধরছি দিদি,একটু দুধ দিন!একটু দুধ দিন!একটু দুধ দিলে আপনার বাচ্চার দুধ কম পড়বেনা।আমি জল মিশিয়ে খাইয়ে দেব।"
       ওই মেয়েটির পাষাণ হৃদয় তবু মেয়েটির প্রতি গলল না।বরং সে হাত সরিয়ে নিল।নিয়ে বলল,"না,তুমি আমার হাত ধরবে না।হাত ধরবে না বলছি।"সে মেয়েটিকে কোন ভাবেই তার হাত ধরতে দিল না।
      মেয়েটি এরপর আর তার হাত ধরবার চেষ্টা করল না।বলল,"বেশ,আপনার হাত ধরব না। আপনি শুধু একটু দুধ দিন!একটু দুধ দিন!"
      ওই মেয়েটি এবার মেয়েটির প্রতি ভীষণ বিরক্ত হয়ে রেগে গিয়ে বলল,"বারবার তুমি কি ধরেছ গো,একটু দুধ দিন,একটু দুধ দিন !দেবনা বললে শুনতে পাও না!"
       মেয়েটি তবু আরেকবার বলল,"একটু দুধ দিন না!"
      না,ওই মেয়েটি এবার আর ধৈর্য ধরতে পারল না।না পেরে সে মেয়েটিকে কষে ধমক মারল,"সাট আপ!"তারপর চোখ রাঙিয়ে বলল,"দুধ দেব না বললে শুনতে পাও না?কেন,তোমার বুকের দুধ খাওয়াতে পারছ না?"
       মেয়েটি উত্তরে বলল,"আমার বুকের দুধ পান করাই না।"
       "কেন পান করাও না?"
       মেয়েটি বলল,"সমস্যা আছে।"
       "কি সমস্যা আছে?মা বাচ্চাকে দুধ পান করাবে এতে আবার সমস্যা কি আছে?"
       মেয়েটি বলল,"সমস্যা আছে।"
       ওই মেয়েটি তখন বলল যে,সে এই প্রথম শুনছে যে,বাচ্চাকে স্তন পান করাতে সমস্যা আছে।আগে সে কখনো কোন মায়ের মুখে এমন কথা শুনেনি।
       মেয়েটি বলল,"সে আপনি না শুনতেই পারেন।আমার সমস্যা আছে তাই সমস্যার কথা বললাম।"
       ওই মেয়েটি এরপর যা বলল তা হল ,"তোমার সমস্যা টমস‍্যা কিছু নেই।আসলে তুমি বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করাতে চাও না।"
       মেয়েটি তার মৃদু প্রতিবাদ করল,"এ আপনি কি বলছেন দিদি!সমস্যা না থাকলে বাচ্চাকে দুধ পান করাব না তাই কি হয়?ভগবান তো মেয়েদের স্তন দুটো বাচ্চাকে পান করানোর জন‍্যই দিয়েছেন।তাছাড়া এ দুটোর আর কি কাজ আছে আমাকে বলতে পারেন?"
       ওই মেয়েটি অমনি বলে দিল,"পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য অনেক মেয়ে আছে বাচ্চাকে স্তন পান করালে স্তনের সাইজ নষ্ট হয়ে যাবে বলে স্তন পান করায় না।তুমিও যে তাদের দলে পড়ছ না তা বুঝব কি করে?"
      ট্রেন ভর্তি মানুষের মধ্যে এতবড় খারাপ কথা বলল ওই মেয়েটি তাকে!দুধ দেবেনা দেবেনা। কিন্তু এতবড় খারাপ কথা বলার সে কে?এ অধিকার সে পেলই বা কোথায়?অতএব মেয়েটির চরম রাগ হয়ে গেল তার প্রতি।রাগের চোটে সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না।ফলে অমনি সে ওই মেয়েটির গালে একটি শব্দ চড় বসিয়ে দিল,"খানকি!"যে চড়ে শব্দ হয় তাকে বলে শব্দ চড়।বসিয়ে দিয়ে তার গলাটা এবার চেপে ধরল,"বল,এরকম কথা কোন মেয়েকে আর কোনদিন বলবি?"
       ওই মেয়েটির পাশে একটি ভদ্রমহিলা বসে আছে।সে মেয়েটিকে ধরে ছাড়িয়ে দিল,"আরে,এ কি করছ!ট্রেনের ভিতর কেউ মারামারি করে?"
       মেয়েটি ভদ্রমহিলাটিকে তখন বলল,"আপনি তো বসে আছেন।সব দেখছেন এবং শুনছেন। আপনি বলুন তো,আমি ওকে কোন দোষের কথা বলেছি কি!আমি আমার ক্ষুধার্ত শিশুটির জন্য শুধু একটু দুধ চেয়েছি।আর ও আমাকে ফট ক‍রে অমন কথা বলে দিল!আমার কি মানসম্মান নেই!মেরে দাঁত মুখ ভেঙে দেব না!"
       ওই মেয়েটি এবার তাকে ইংরেজিতে গালি দিল,"প্রস্টিটিউট!এবার মারতে আয় দেখি।যদি তোর হাত দুটো দুমড়ে মুচড়ে না দিই।"
       তার ওই কথা শুনে মেয়েটি তখন ভীষণ ক্রোধে তার দিকে আবার এগিয়ে যেতে গেল,"তোকে এই ট্রেনের মধ্যেই মেরে সাট করব।দেখি তুই আমার কি করতে পারিস।"
      সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রমহিলাটি তাকে ফের ধরে নিল। তার কাছে তাকে যেতে দিল না।নিয়ে ওই মেয়েটিকে বকতে লাগল,"তুমি চুপ করতে পারছ না!"
       ওই মেয়েটি তার উত্তরে ভদ্রমহিলাটিকে বলল,"কেন চুপ করব?দেখলেন না,প্রস্টিটিউটটি কেমন করে আমাকে মেরে গেল?"
       "কথাটি বলা যে তোমার অন‍্যায় হয়েছে।" ভদ্রমহিলাটি তাকে তখন বলল।
      "আমার কিছু অন‍্যায় হয়নি।এরা এই ধরনেরই মেয়ে,বুঝলেন?আমরা মানুষ দেখলে চিনতে পারি।"
      মেয়েটি তখন ভদ্রমহিলাটিকে বলল,"ম‍্যাডাম,আপনি ওকে সাবধান করে দিন!এবং চুপ করতে বলুন!নাহলে কিন্তু----"
      ভদ্রমহিলাটি ওই মেয়েটিকে তখন বলল,"তুমি চুপ করো!"
      সে চুপ করল না।বরং সরাসরি মেয়েটিকে সে বলল,"আমি চুপ করব না।তার কি বলছিস,প্রস্টিটিউট!"
      সেই তখন থেকে সে মেয়েটিকে ইংরেজিতে গালি দিয়েই চলেছে।কিন্তু মেয়েটি একবারও একটি ইংরেজি শব্দ ব‍্যবহার করেনি।এবার সে ব‍্যবহার করল,"prostitute!I am not prostitute.I am a good-charactered woman.But you are not.So your mother is prostitute.your father is prostitute.And your brother and sister  prostitute।..."অনবরত সে ইংরেজিতে গালি দিয়েই চলল।তার ইংরেজি গালির কাছে সে দাঁড়াতে পারল না।সাধারণ চেহারার এবং সাধারণ পোশাকের মেয়েটির মুখে ইংরেজি গালি শুনে ওই মেয়েটি এবার আপনি থেমে গেল।তাকে এবার আর কাউকে থামতে বলতে হল না।যদিও থামবার আগে সে একটি মৃদু প্রতিবাদ করল,"খবরদার! তুই আমাকে যা খুশি বল।কিন্তু আমার মা-বাবা এবং দাদা-দিদিকে এর মধ্যে একদম টেনে আনবি না,বলে দিলাম।"
       সাধারণ চেহারার এবং সাধারণ পোশাকের মধ্যেও যে অনেক আগুন লুকানো থাকে মেয়েটি তার প্রমাণ দিল।


                                           চার


  বাচ্চাটি মেয়েটির কোলে এখনও কাঁদছে। এখনও তার কান্না থামেনি।কারণ তার পেটে যে এখনো খাবার পড়েনি।সুতরাং বাচ্চাটির কান্না দেখে ভদ্রমহিলাটি বলল,"ইস্,বাচ্চাটির খুব খিদে পেয়েছে!"
     "হ‍্যাঁ,খুব খিদে পেয়েছে।তা-ও দেখুন,বাচ্চাকে স্তন পান করাতে পারছিনা।কারণ----"
     "কারণ?"
     "কারণ আমার স্তন পান করানো বারণ আছে। ডাক্তার বাবু বারণ করেছেন।ডাক্তার বাবুর পরামর্শ মতো তাই প্রথম থেকেই কৌটোর দুধ খাওয়াচ্ছি।"
      "ডাক্তার বাবু বারণ করেছেন কেন?"
      মেয়েটি তখন বলল,"এর আগে আমার চারটে সন্তান হয়ে মারা গেছে।তা-ও আবার সব গুলোই কচি অবস্থায়।বারবার এরকম কেন হচ্ছে?কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে আমার স্তনের দোষ আছে।ডাক্তার বাবু তাই কঠিন ভাবে বারণ করে দিয়েছেন,আমি যাতে কখনোই বাচ্চাকে স্তন পান না করাই।তাহলে বাচ্চা মারা যাবে।আগের বাচ্চা গুলো যেভাবে মারা গেছে।তাই বাচ্চাকে স্তন পান করাই না।কিন্তু দেখুন,মানুষ সেটা না জেনে বুঝে অন‍্য রকম মন্তব্য করে মনে কষ্ট দিচ্ছে।"
      ভদ্রমহিলাটি বলল,"তোমার সমস্যা আমি ঠিক বুঝেতে পেরেছি।কিন্তু তুমি এখন কি করবে?"
     "সেটাই তো ভাবছি,আমি এখন কি করব?"
      একটু ভেবে ভদ্রমহিলাটি বলল,"তুমি একটা কাজ করো।এদিক ওদিক একটু ঘুরে দেখো। কারো না কারো কাছে একটু দুধ ঠিকই পেয়ে যাবে।নাহলে বাচ্চাটা যেভাবে কান্না করছে মারা যাবে তো।"
     সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটির চোখে জল চলে এল,"না,অমন কথা বলবেন না।"তারপর বাচ্চাটিকে বুকে করে মেয়েটি এবার এদিক ওদিক ঘুরে দেখতে লাগল কার কোলে দুধের বাচ্চা রয়েছে।কে বাচ্চাকে দুগ্ধ পান করাচ্ছে।যার কোলে দুধের বাচ্চা দেখতে পেল তার কাছেই একটু দুধের জন্য ছুটে গেল।কিন্তু কারও কাছেই একটু দুধ মেয়েটি পেল না।দুধ নেই বলে দুধ থেকেও কেউ দুধ দিল না।ক্রন্দনরত শিশুটিকে বুকে করে মেয়েটি সারা বগি ঘুরল।কোথাও একটু দুধ না পেয়ে মেয়েটি তার জায়গায় ফিরে এসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল,"ঠাকুর!তুমি করুণা করো ঠাকুর!আমার বাচ্চাটার তুমি বাঁচিয়ে দাও।একটু দুধ কোথাও পেলাম না।কেউ দিল না।একটু দুধের তুমি ব‍্যবস্থা করে দাও,ঠাকুর!"
     বাচ্চাটি তখন কান্না করতে করতে 'খক খক' করে উঠল।মেয়েটি তখন জোর চিৎকারে কান্না করে উঠল,"ঠাকুর র র র..!"
     এরপর বাচ্চাটির খক খক বন্ধ হলে সেই বয়স্কা মেয়েটি তাকে বলল,"এতবড় বগিতে কোথাও একটু দুধ পেলে না?"
     "না।কোথাও একটু দুধ পেলাম না।দুধ থেকেও কেউ একটু দুধ দিল না আমার বাচ্চার জন্য।" কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটি বলল।
     "আশ্চর্য!কেউ একটু দুধ দিল না!এরা কি সব মানুষ!না এরা কেউ মানুষ নয়।সব মানুষের মতো। কারণ মানুষ কোনদিন এত কঠোর হতে পারে না।..."বলতে বলতে বয়স্কা মেয়েটি ভগবানকে ডাকল,"ভগবান,তুমি এই মানুষ রূপীদের উপর অভিশাপ বর্ষণ করো।দুধ থেকেও যারা দুধের এই ক্ষুধার্ত শিশুটিকে একটু দুধ দিল না তুমি তাদের উপর অভিশাপ বর্ষণ করো।কখনো তাদের উপর করুণা বর্ষণ করোনা।কখনো তাদের উপর..."অভিশাপ দিতে দিতে বয়স্কা মেয়েটি উঠে দাঁড়াল।ক্রন্দনরত বাচ্চাটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।দিয়ে মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলল,"মা,তোমরা থাকো।কোন চিন্তা করোনা।ভগবান আছেন।উনি নিশ্চয় তোমার ছেলের ক্ষুধা নিবারণ করবেন।"
     মেয়েটি তখন তাকে জিজ্ঞেস করল,"আপনি কি নেমে যাবেন নাকি?"
     বয়স্কা মেয়েটি বলল,"হ‍্যাঁ,মা।স্টেশনে ট্রেন ঢুকছে।আমি নেমে যাবো।"
     মেয়েটি তখন তাকে বলল,"আমার বাচ্চাকে আশির্বাদ করুন!"
     বয়স্কা মেয়েটি আশির্বাদ করল তৎক্ষণাৎ,"ভগবান নিশ্চয় তোমার বাচ্চার প্রতি সহায় হবেন।নিশ্চয় তিনি তোমার বাচ্চাকে দীর্ঘজীবী করবেন।"
     তার আশীর্বাদে সন্তুষ্ট হয়ে মেয়েটি বলল,"ভগবান আপনার মঙ্গল করুন!"
    "গাড়ি ঢুকে গেছে,মা।আমি নেমে যাচ্ছি।"
    "ঠিক আছে,যান।"


                                        পাঁচ

বয়স্কা মেয়েটি নেমে যাওয়ার পর ওই সিটটা এখন খালি হয়ে গেল।কিন্তু খালি থাকল না। তক্ষুনি একটি মেয়ে বসে গেল।মেয়েটি দেখতে সাঁওতাল মেয়ের মতো একেবারে কালো কুচ্ছিত। মেয়েটির এক হাতে একটি ভারি ব‍্যাগ ধরা আছে। আর এক হাতে বুকের সঙ্গে একটি বাচ্চা ধরা আছে।সিটে বসার আগে সে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল,"দিদি,এখানে কেউ আছে?"
      মেয়েটি মাত্র এক পলক তার দিকে তাকিয়ে দেখে বলল,"কেউ নেই।বসো।"
      মেয়েটি অমনি সিটে বসে গেল।বসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুকের বাচ্চাটিকে সে স্তন পান করাতে লাগল।স্তন পান করানোর সময় কাপড় দিয়ে নিজের বুক ভালো করে ঢেকে নিল।যাতে তার স্তন পান করানো কেউ দেখতে না পায়।পান করাতে করাতে একটি স্তন পান করানো হয়েছে ওইসময় মেয়েটির বাচ্চাটি ফের খক খক করে উঠল। আগের বারের মতো মেয়েটি তখন আবারও কেঁদে উঠে ঠাকুরকে ডাকল,"ঠাকুর র র র...!"
     কালো মেয়েটি এবার তার বাচ্চার মুখ থেকে তাড়াতাড়ি করে স্তন ছাড়িয়ে নিয়ে মেয়েটির প্রতি ব‍্যস্ত হয়ে পড়ল,"আপনার বাচ্চার কি হয়েছে ,দিদি?" 
      মেয়েটি ক্ষোভে,দুঃখে কোন কথা বলল না। তার চোখ থেকে শুধু জল ঝরে পড়ল।
      মেয়েটি কথা না বললে পরে কালো মেয়েটি ফের তাকে জিজ্ঞেস করল,"আপনার বাচ্চার কি হয়েছে,দিদি?"
      মেয়েটি বলল,"শুনে কি করবে?"
      "বলুন না,শুনি!"
      "শুনবে তো শোনো তাহলে।"মেয়েটি পুরো ঘটনাটা কালো মেয়েটিকে শোনাল।শোনার পর কালো মেয়েটি বলল,"আমি যদি আপনার বাচ্চাকে স্তন পান করাই আপনার কোন অসুবিধা আছে?আমার স্তনের কোন দোষ নেই।"
      মেয়েটি চোখ মুছে বলল,"কোন অসুবিধা নেই। তুমি আমার বাচ্চাকে তোমার স্তন পান করাও।"
       কালো মেয়েটি তখন বলল,"জাতে আমি বাগদি।বাগদি মেয়ের স্তন পান ক‍রলে আপনার বাচ্চার জাত যাবেনা তো?"
      মেয়েটি বলল,"না,জাত যাবে না।জাত যাবে কেন?তুমিও মা আমিও মা।তুমিও মেয়ে আমিও মেয়ে।তুমিও হিন্দু আমিও হিন্দু।তুমিও ঠাকুরের পুজো করো আমিও ঠাকুরের পুজো করি।জাত যাবেনা।তাছাড়া আমার কাছে এখন জাত বাঁচানোর চাইতে আমার বাচ্চার জান বাঁচানো অনেক বেশি জরুরি।তুমি আমার বাচ্চাকে স্তন পান করাও,বোন।"
      আর একটুও দেরি করল না কালো মেয়েটি। সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাটিকে সে তার কোলে চাইল,"বাচ্চাটি আমার কোলে দিন!"
     মেয়েটি বাচ্চাটি তার কোলে দিল,"নাও বোন,তাড়াতাড়ি তোমার স্তন পান করাও।"
      কালো মেয়েটি এবার বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে স্তন পান করাতে লাগল।যে স্তনটা তার বাচ্চাকে পান করানো হয়নি।কিন্তু এবার সে কাপড় দিয়ে তার বুক ঢাকল না।সবাইকে দেখিয়ে প্রকাশ‍্যে স্তন পান করাল।তাদেরকে দেখাল,দেখ।তোরা একটু দুধ দিস নি যে বাচ্চাটিকে আমি তাকে কেমন করে স্তন পান করাচ্ছি।তাদের চরম লজ্জা দিল।
       পুনশ্চঃবাচ্চাটির এরপর আপনি কান্না থেমে গেল।সে আনন্দে হাসতে লাগল।বাচ্চার হাসিতে বাচ্চার মা মেয়েটিও হাসল।স্তন পান করালো যে সেই কালো মেয়েটিও।


কোন মন্তব্য নেই: