সোমবার, ৩০ মার্চ, ২০২০

কবিতা : অনিরুদ্ধ সুব্রত



                        প্রিয় মৌসুমী বায়ু 
                            অনিরুদ্ধ সুব্রত 

পশ্চিমি ঝঞ্ঝা-ক্ষুব্ধ দিন গুলোর কথা এখন ভুলে যাচ্ছি 
পলাশের রক্ত-আগুনের তাপে সেই তো শেষ বার সেঁকে নিয়েছি
বসন্তের বাতাস বরাবর জ্যোস্না-রাতের বাঁশি বেজেছে কতই
মেহগনি সংবেদে ফিরেছে আবার, হিমালয় ছেড়ে গৃহী-সন্ন্যাসীর মতোই
 উদাসীন শূন্য চৈত্র-মাঠ আবার ধরেছে বায়না, নিজস্ব ফসল-গর্ভ-গান 
দূরে একটি দু'টি খেজুর গাছের হৃদয় আকাশের গায় কাঁটা ফুটিয়ে দেয় ।

 
   ভাবছিলাম নাম হোক 'দুপুরবেলা' আমার, বিশেষত এই বয়সে মানায়
শরীরের নাম গ্রীষ্মকাল। ঘেমে নেয়ে কাব্য কি হয়, অস্বস্তির চালসে গায়
ফুটো ফাটা ত্রিপল ঢাকা ঘুন ধরা সেই বাঁশের খুঁটি। চেষ্টা চলে পরিপাটি 
তবুও ফাঁটে চাষের মাটি,রসের অভাব,শুকিয়ে আসে গভীর থেকে বুক অবধি।

একটু একটু থমকে বাতাস, অনেকটা শীত শীতল থেকে,ধুলো ধোঁয়ার পথ
কখন দেখি অসহ্য বোধ, গুমোট হয়ে সমস্ত ভাব, মাথায় ওঠে সব উত্তাপ ।
মাঝ দুপুরের আগুনে খাগ দু'চোখ শুধু ধূ ধূ,কাজের মানুষ, মগডালে এক ঘুঘু ।
সহ্য হয় না কঠিন পাচ্য, না-হজম কতই স্বাদ,অসাধ্য সাধ্য করার তবুও সেই সাধ
অনবরত ঘামে ভেজে সহায় যত, ভিজে ওঠে নাক, পিছলে যায় চশমাটা আর
পিছিয়ে পড়ে হাত ।

তবুও বলি ফিরিস্তি এ সব, দুপুরবেলা পাল্টে শরীরের নাম যে গ্রীষ্মকাল।
তাপ সয়ে যাক,বন্ধ বাতাস তাও সয়ে যাক, এখানে জমুক গভীর নিম্নচাপ ।
সকাল ফিরে কী করে পাবে, বাড়ি তোমার নিরক্ষীয়--- বদলে নেবে ? 
কোন সকাশে কে-ই বা আছে, জলের কাছে ঘর, এখানে শুধুই বালির ঝড়।
প্রিয় আমার মৌসুমী বায়ু, এই রোদ্দুর এই দুপুরে, এক পশলা বৃষ্টি নামাবে ?

                                                                                

কবিতা : শুধ ব্রত রাউত


                                     কুহুক 

                               শুদ্ধ ব্রত রাউত


              যে যার মতো হাসবে
             আর যে যার মতো বেরিয়ে যাবে
             ব্যক্তিগত গরিমা মকশো করতে

            ঢেউ এসে খুলে নেবে পা
            তারপর ঢেউয়ের পেছন ছুটে
           পায়ের কথা ভুলে তিন/দুই/এক
           ফিরে যাবে গৃহহীনতায় 

          শুধু দেয়াল দিয়ে বেঁধে রাখলেই
          শূন্যত্যাগী হয় না সব
          ছাদের গায়ে বেজে উঠলেই
         পুরনো আওয়াজ নিজের-
         বলে মানে না শ্মশান-কোকিল

         কিছু কি ছিলো কখনো?
        এমন ভাবলেই তো খুলে নিতে হয়
         দুর্বোধ্য হরফের ট্রাঙ্ক

        কিছু কি বদলেছে আদৌ?
        যা ছিলোই না তার গতি কেমন আবার!
       রিক্সার চাকা! 
        চলমান রাস্তা;
       পরক্ষণে দেখি সে স্থির আছে আগের মতো!

        এ সবই কেবল আবহ বোধয়
      যে জামানা পেতেছে যেমন বীর্যের মাদুর!

        ঘড়ির দিকে- 
       তাকাতে ভালো লাগে তাই
       দিনরাত মিলিয়ে অন্তত ৩/২/১ বার
      কখনো বড় কাটা টা হয়ে ওঠে 
      ধুসর একটা T-rex
      ছোট টা ব্লুয়িশ হামিংবার্ড
      এমন করে কোন কিছুই আর আমি হয়ে ওঠে না

কবিতা : দেবাশীষ সাহা



                                                    পথ  

                             দেবাশীষ সাহা

    
                                নৌকা ফুটো হয়ে গেলে   
                                বাতাসে ভরে যায় নির্জনতা 

                               বিষে তীব্র কোলাহল 

                              বিজয়ী পতাকা হাতে
                              পথে পথে দাঁড়িয়ে মৃত্যু 

                            সে কি তোমার আম্বাসাডার

কবিতা : নিত্য রঞ্জন মণ্ডল


                        বৃষ্টি আসা মেঘে

                              নিত্য রঞ্জন মণ্ডল



   সুদূরের চলন্ত  ট্রেনে তোমারে দেখেছি
   ভালোবাসার মানে এই হয় না কি
   সদ্য সকালে ঝুরে পড়া গোলাপের শিশিরে
   ভেজা পাপড়ি,  শূণ্যতা  উঠান ;
   কেউ নেই,  শূণ্যতার ডাকে
   ভাঙা জানলা চৌকাঠ, দু' টি চোখ চেয়ে থাকে ;
   বৃষ্টি আসা মেঘে
   আমার বিছানার চাদর ভিজে গেছে
   রাতের গভীর আঁধারে গায়ে সেই ছেঁড়া কাঁথা
   আজ আর গন্ধ পাই না
   আমার সেই ভাঙা ঘর নেই
   ভাড়া ঘরে থাকি --- কত কথা মুখে মুখে,
   ভাড়া দিতে দেরি হলে জীবনের স্রোতে টেনে নিয়ে     যায়
   বাড়ীর মালিকের মৃত্যুর মত চোখ রাঙানি
   আমি শুধু জীবন্ত ভাবে দেখেছি। 

কবিতা : অনুপ মণ্ডল


                                   হাওয়া

                                              অনুপ মণ্ডল

।।আফিম-অন্ধকারের আদলেই এখানে সঙ্গম শেখানো হয়।।/অন্ধকারে অন্ধকারে পাথর মসৃণ হয়ে ওঠে/
# # # # # # # # # # # # # # # # # # # # # # #
উল্টোদিকে একটা দুমুখ খোলা পাতি সংসার/১০২ডিগ্রি জ্বর নিয়ে/ল‍্যাম্পপোস্টে ল‍্যাম্পপোস্টে কাত হয়ে ঝুলছে/ক্লিনিক‍্যাল থার্মোমিটার ও বিজ্ঞাপনের নারী/কেবলই দুলছে/
# # # # # # # # # # # # # # # # # # # # # # #
মাঝের রাস্তাটাকে আমরা সংকটকাল বলি/কেউকেউ বলে প্রণবদা বা মদনবাবু কেউ বলে হাওয়া/একটু খুঁড়িয়েখুঁড়িয়ে চলা একটু লব্ধকাম/হাওয়ার ভালো আছে হাওয়া মন্দও হয়/আবহাওয়া দপ্তরের সদর দরজা বন্ধ হয়ে গেলে/যে কোনও দিকেই মুখ করে মোরগ ডেকে উঠতে পারে।

কবিতা: সৌমিত্র চ্যাটার্জী


                 এখনও পোড়েনি হৃদয়

                             সৌমিত্র চ্যাটার্জী 



আজ বেদনাকে বলছো ধরতে হাত
এখনও চঞ্চল সুমেরুশীর্ষে বরফ কাঁপানো শীতঝড়
এখনও পোড়েনি হৃদয় জুড়ে সব গোলাপের অস্থিমজ্জা
হয়তো ভেঙে যাবে আজ
অনন্ত প্রতীক্ষার চিরুণী সংলাপ

আমাকে হারাতে চাও
তোমার স্পর্শে উদ্দাম ছিল দেহকোষ
রোমকূপে যখন পড়েছে ধারালো তুষারাঘাত
আমাকে ভাসাতে পেরেছো পরিপূর্ণ বিষে
সে কি আমার দোষ

পূর্ণ বাস্পে পরিনত স্মৃতির আঙুররস 
ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাও অগোছালো মন ধুপের ধোঁয়ার মত
জানালার নিচে ছাই এর মত
উড়ে বেড়ায় জমকালো শীতাতপ

মুঠো মুঠো তুষার ভরে দিয়েছো লবনাক্ত ফুসফুসে
মেঠো বাতাসের কাছে লিপিবদ্ধ আছে 
দূরন্ত সব অভিযোগ...


অনুগল্প : আবদুস সাত্তার বিশ্বাস



                             বাগদি মেয়ে

                                      আবদুস সাত্তার বিশ্বাস
                       
                              

                                                 এক

 বেগে ট্রেন চলছে।হকারদের চিৎকার চেঁচামেচিও চলছে।একটি হিজড়ে হাত তালি দিয়ে পয়সা আদায় করছে।এই পয়সা দে।এই পয়সা দে।পয়সা যে দিচ্ছে খুশি হয়ে তার গালে চুমো দিচ্ছে।পয়সা যে না দিচ্ছে রেগে গিয়ে তার গালে থাপ্পড় দিচ্ছে।আর যা তা ভাষায় তাকে গালি দিচ্ছে।তবে সবাইকে নয়।যারা বয়সে তরুণ এবং দেখতে সাধারণ চেহারার কেবলমাত্র তাদেরকে। অর্থাৎ মানুষ চিনে চিনে।কোন কোন সময় কারও পকেট থেকে হাত ঢুকিয়ে পয়সা বের করে নিচ্ছে।সে পয়সা আর ফেরত দিচ্ছে না।দেখে দেখে অনেকে বুক পকেটের পয়সা সামলিয়ে রাখছে।সতর্ক হচ্ছে।
     গেটের ডান দিকে সিটে বাচ্চা কোলে একটি মেয়ে বসে রয়েছে।বাচ্চাটির বয়স আন্দাজ মাস ছয়েকের বেশি হবে না।বাচ্চাটি মেয়েটির কোলে এখন ঘুমাচ্ছে।নিশ্চয় তার পেট ভর্তি আছে বলে ঘুমাচ্ছে।পেট ভর্তি না থাকলে কখনোই এভাবে অর্থাৎ এত শান্ত ভাবে কোন বাচ্চা ঘুমাবে না।এই বাচ্চাটিও ঘুমাত না।অনেক আগেই তার ঘুম ভেঙে যেত।আর মায়ের কোলে সঙ্গে সঙ্গে কান্না জুড়ে দিত।মেয়েটি এখন যেভাবে হিজড়েটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।আর তাকিয়ে তাকিয়ে যেভাবে তার পয়সা আদায় করা দেখছে বাচ্চাটির ঘুম ভেঙে গেলে কখনোই মেয়েটি তা দেখবার সময় পেত না।বাচ্চাটির কান্না থামাতে আর তাকে সামলাতে তাকে ব‍্যস্ত হয়ে পড়তে হতো।কারণ পেটে খিদে না পেলে এই ধরনের বাচ্চাদের সচরাচর ঘুম ভাঙে না।সুতরাং তার যখন ঘুম ভাঙবে তখন আমরা ধরে নেব যে তার খিদে পেয়েছে।এ কি!বলতে বলতে তার খিদে পেয়ে গেল!ওই তো তার ঘুম ভেঙে গেছে।কান্না করছে।মেয়েটি তার কান্না থামানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে।তাকে সামলাতে মেয়েটি ওই তো ব‍্যস্ত হয়ে পড়েছে।আদর করছে।সোহাগ করছে।"ও ও ও...কি হয়েছে...কি হয়েছে.... দেখি দেখি...ও ও ও...সোনা আমার.... চাঁদ আমার...ও ও ও...!"
      কিসে কি!কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।বাচ্চাটির কান্না থামছেনা।বরং আরো জোরে জোরে কাঁদছে।মানুষের যখন খুব খিদে পায় ভালো কথাও যে তার তখন শুনতে ভালো লাগেনা। বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও একই রকম ঘটে।তাদের কান্নার সময় যত বেশি আদর করা যায় কান্না তাদের তত বেশি বৃদ্ধি পায়।কিন্তু তাদের মুখের ভিতর যখন স্তনবৃন্ত ঢুকে দেওয়া হয় কান্না ঠিক থেমে যায়।ফলে মেয়েটি এখন খুব সহজেই অনুমান করে নিল যে,তার বাচ্চার ক্ষুদ্র পেটে খুব খিদে পেয়েছে।তাকে এক্ষুনি দুধ পান করাতে হবে।নাহলে কোন সোহাগেই যে এখন তার কান্না থামবে না।কেঁদেই যাবে।সে কেঁদেই যাবে।


                                         দুই

 অতঃপর মেয়েটি যেই দুধ গুলে বাচ্চাটিকে খাওয়াবে ভাবল অমনি তার মনে পড়ে গেল যে,বিরাট ভুল হয়ে গেছে।ট্রেনে উঠার সময় স্টেশনে সে ব‍্যাগ ভুলে গেছে।সিমেন্টের একটা ঠেস বেঞ্চে বসে বাচ্চাকে সে দুধ গুলে খাওয়ানোর পর ব‍্যাগটা পাশে রেখেছিল।তারপর ট্রেন চলে এলে তাড়াতাড়ি করে সে ট্রেনে উঠে পড়ে।এবং ব‍্যাগটা নিতে ভুলে যায়।এখন সেটা মনে পড়ছে।মনে পড়ছে বলে কপালে সে হাত দিল,"হায়!সর্বনাশ হয়ে গেছে।"
      মেয়েটির পাশে একটি বয়স্কা মেয়ে বসে আছে।পরনে তার সাদা শাড়ি।মেয়েটির 'হায়! সর্বনাশ হয়ে গেছে' শুনে বয়স্কা মেয়েটি তাকে বলল,"মা,তোমার কি সর্বনাশ হয়ে গেছে?"
      মেয়েটি বয়স্কা মেয়েটিকে তার সর্বনাশের কথা বলল।বয়স্কা মেয়েটি তার সর্বনাশের কথা শুনে  ভীষণ দুঃখ পেল।আর তাই তার মুখ থেকে তখন বেরিয়ে গেল,"ইস্!সত্যিই তো দারুণ সর্বনাশ হয়ে গেছে তোমার।"তারপর বলল,"ব‍্যাগে নিশ্চয় টাকা ছিল?"
      "সে তো ছিলই।"মেয়েটি বলল।
      বয়স্কা মেয়েটি তখন বলল,"এতবড় ভুল কেউ করে!"
      মেয়েটি বলল,"ভুল কি আমি ইচ্ছা করে করেছি?ভুল হয়ে গেছে তো আমি কি করব বলুন!"
       "ব‍্যাগে তোমার কত টাকা ছিল?"
       "তিন হাজার টাকা।আর একটা মোবাইল ছিল।"
       শুনে বয়স্কা মেয়েটি "হায় হায়" করে উঠল।ও বলল যে,যে শালা পাবে সে শালা একেবারে বসিয়ে দেবে।তারপর মেয়েটিকে প্রশ্ন করল,"কি বসিয়ে দেবে না?"
      মেয়েটি বলল,"দেবেই তো।"বললে পরে বয়স্কা মেয়েটি বলল,"আমার জান বিষিয়ে গেল গো। তোমার জিনিস হারিয়েছে তোমার তো তাহলে জান বিষাবেই।"
      মেয়েটি বলল,"টাকা বা মোবাইলের জন্য অত জান বিষাচ্ছে না আমার।আমার জান বিষাচ্ছে বেশি অন্য জিনিসের জন্য।"
      বয়স্কা মেয়েটি  সঙ্গে সঙ্গে বলল,"তাহলে কি ব‍্যাগে তোমার সোনাদানা ছিল?"
       "না।ওসব কিছু ছিল না।"
       "তাহলে মূল্যবান জিনিস আর কি ছিল যে,সেটার জন্য তোমার-----"
       মেয়েটি বলল,"বাচ্চার দুধ ছিল।দুধের জন্য আমার বেশি জান বিষাচ্ছে।কেননা টাকা গিয়েছে টাকা আবার আসবে।মোবাইলও যখন তখন আবার কিনতে পারব।কিন্তু বাচ্চার এখন খিদে পেয়েছে।খিদের জ্বালায় কান্না করছে।বাচ্চার কান্না এখন কি দিয়ে থামাব?কান্না করতে করতে বাচ্চার যদি কিছু হয়ে যায় বাচ্চা কি কোথাও আর পাবো?তাই বাচ্চার দুধের জন‍্যই আমার বেশি জান বিষাচ্ছে।ভগবান যাতে আমার বাচ্চার কিছু না করেন।কিছু না করেন।"
      মেয়েটির এই কথা থেকে তার মনের কষ্ট বুঝতে পেরে বয়স্কা মেয়েটি বলল,"ওদিকে তাকাও।দেখো,একটি মেয়ে তার বাচ্চার জন্য দুধ গুলছে।তুমি তার কাছে একবার যাও।গিয়ে তোমার বাচ্চার জন্য একটু দুধ চেয়ে আনো।..."

    

                                              তিন

  বয়স্কা মেয়েটির কথা মতো মেয়েটি তাই করল।তাকিয়ে দেখল,সত্যি সত্যি একটি মেয়ে তার বাচ্চার জন্য দুধ গুলছে।যদিও তার বাচ্চাটি কান্না করছে না।কোলে শান্ত হয়ে বসে রয়েছে। দেখার পর মেয়েটি ওই মেয়েটির কাছে এগিয়ে গেল।যাওয়ার সময় পাশের বয়স্কা মেয়েটিকে বলে গেল যে,তার জায়গাটা সে যেন একটু দেখে। সে একটু ওই মেয়েটির কাছ থেকে আসছে।
      বয়স্কা মেয়েটি "ঠিক আছে দেখছি,যাও।"বলে মেয়েটিকে পাঠাল।
       মেয়েটি ওই মেয়েটির কাছে গেল।গিয়ে দাঁড়ানোর পর তাকে বলল,"দিদি,আমার বাচ্চাটার জন্য একটু দুধ দিন না!"কাতর প্রার্থনা করল।
      মেয়েটির প্রার্থনা শুনে ওই মেয়েটি তার দিকে চোখ তুলে শুধু একবার তাকাল।কিন্তু কোন উক্তি টুক্তি করল না।
        না করলে মেয়েটি ফের বলল,"দিদি,একটু দুধ দিন না!"
       কিন্তু ওই মেয়েটি তার কথা শুনল না।না শুনলে মেয়েটি তখন বলল,"বাচ্চাটার খুব খিদে পেয়েছে।খিদের জ্বালায় কান্না করছে।এত যে সোহাগ করছি তা-ও থামছে না।দেখতেই পাচ্ছেন।তাই বলছি,একটু দুধ দিন না!"
       দুধ গুলতে গুলতে ওই মেয়েটি এবার বলল,"তোমার বাচ্চার খিদে পেয়েছে তো আমি কি করব শুনি!"তারপর বলল,"খিদে পেয়েছে দুধ খাওয়াও। আমাকে তার কি বলছ?"
      মেয়েটি বলল,"আমার কাছে দুধ নেই।আপনি একটু দুধ দিন না!"
      ওই মেয়েটি তার উত্তরে বলল,"কোলে বাচ্চা আছে।বাচ্চার দুধ নেই কেন?" 
       মেয়েটি বলল,"বাচ্চার দুধ,একটা মোবাইল ফোন ও তিন হাজার টাকা একটা ব‍্যাগে রাখা ছিল।ব‍্যাগটা স্টেশনে ভুলে গেছি।"
      "ভালো করেছ।তা আমি কি করব?"ওই মেয়েটি বলল।
      "আপনার বাচ্চার জন্য তো দুধ গুলছেন। ওতে থেকে একটু দুধ দিন না!"
       সঙ্গে সঙ্গে ওই মেয়েটি বলে উঠল,"তুমি কি বললে!আমার বাচ্চার দুধ তোমার বাচ্চাকে দেব! নো,নেভার!"
       মেয়েটি অমনি তার হাতে ধরতে গেল ,"আপনার হাতে ধরছি দিদি,একটু দুধ দিন!একটু দুধ দিন!একটু দুধ দিলে আপনার বাচ্চার দুধ কম পড়বেনা।আমি জল মিশিয়ে খাইয়ে দেব।"
       ওই মেয়েটির পাষাণ হৃদয় তবু মেয়েটির প্রতি গলল না।বরং সে হাত সরিয়ে নিল।নিয়ে বলল,"না,তুমি আমার হাত ধরবে না।হাত ধরবে না বলছি।"সে মেয়েটিকে কোন ভাবেই তার হাত ধরতে দিল না।
      মেয়েটি এরপর আর তার হাত ধরবার চেষ্টা করল না।বলল,"বেশ,আপনার হাত ধরব না। আপনি শুধু একটু দুধ দিন!একটু দুধ দিন!"
      ওই মেয়েটি এবার মেয়েটির প্রতি ভীষণ বিরক্ত হয়ে রেগে গিয়ে বলল,"বারবার তুমি কি ধরেছ গো,একটু দুধ দিন,একটু দুধ দিন !দেবনা বললে শুনতে পাও না!"
       মেয়েটি তবু আরেকবার বলল,"একটু দুধ দিন না!"
      না,ওই মেয়েটি এবার আর ধৈর্য ধরতে পারল না।না পেরে সে মেয়েটিকে কষে ধমক মারল,"সাট আপ!"তারপর চোখ রাঙিয়ে বলল,"দুধ দেব না বললে শুনতে পাও না?কেন,তোমার বুকের দুধ খাওয়াতে পারছ না?"
       মেয়েটি উত্তরে বলল,"আমার বুকের দুধ পান করাই না।"
       "কেন পান করাও না?"
       মেয়েটি বলল,"সমস্যা আছে।"
       "কি সমস্যা আছে?মা বাচ্চাকে দুধ পান করাবে এতে আবার সমস্যা কি আছে?"
       মেয়েটি বলল,"সমস্যা আছে।"
       ওই মেয়েটি তখন বলল যে,সে এই প্রথম শুনছে যে,বাচ্চাকে স্তন পান করাতে সমস্যা আছে।আগে সে কখনো কোন মায়ের মুখে এমন কথা শুনেনি।
       মেয়েটি বলল,"সে আপনি না শুনতেই পারেন।আমার সমস্যা আছে তাই সমস্যার কথা বললাম।"
       ওই মেয়েটি এরপর যা বলল তা হল ,"তোমার সমস্যা টমস‍্যা কিছু নেই।আসলে তুমি বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করাতে চাও না।"
       মেয়েটি তার মৃদু প্রতিবাদ করল,"এ আপনি কি বলছেন দিদি!সমস্যা না থাকলে বাচ্চাকে দুধ পান করাব না তাই কি হয়?ভগবান তো মেয়েদের স্তন দুটো বাচ্চাকে পান করানোর জন‍্যই দিয়েছেন।তাছাড়া এ দুটোর আর কি কাজ আছে আমাকে বলতে পারেন?"
       ওই মেয়েটি অমনি বলে দিল,"পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য অনেক মেয়ে আছে বাচ্চাকে স্তন পান করালে স্তনের সাইজ নষ্ট হয়ে যাবে বলে স্তন পান করায় না।তুমিও যে তাদের দলে পড়ছ না তা বুঝব কি করে?"
      ট্রেন ভর্তি মানুষের মধ্যে এতবড় খারাপ কথা বলল ওই মেয়েটি তাকে!দুধ দেবেনা দেবেনা। কিন্তু এতবড় খারাপ কথা বলার সে কে?এ অধিকার সে পেলই বা কোথায়?অতএব মেয়েটির চরম রাগ হয়ে গেল তার প্রতি।রাগের চোটে সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না।ফলে অমনি সে ওই মেয়েটির গালে একটি শব্দ চড় বসিয়ে দিল,"খানকি!"যে চড়ে শব্দ হয় তাকে বলে শব্দ চড়।বসিয়ে দিয়ে তার গলাটা এবার চেপে ধরল,"বল,এরকম কথা কোন মেয়েকে আর কোনদিন বলবি?"
       ওই মেয়েটির পাশে একটি ভদ্রমহিলা বসে আছে।সে মেয়েটিকে ধরে ছাড়িয়ে দিল,"আরে,এ কি করছ!ট্রেনের ভিতর কেউ মারামারি করে?"
       মেয়েটি ভদ্রমহিলাটিকে তখন বলল,"আপনি তো বসে আছেন।সব দেখছেন এবং শুনছেন। আপনি বলুন তো,আমি ওকে কোন দোষের কথা বলেছি কি!আমি আমার ক্ষুধার্ত শিশুটির জন্য শুধু একটু দুধ চেয়েছি।আর ও আমাকে ফট ক‍রে অমন কথা বলে দিল!আমার কি মানসম্মান নেই!মেরে দাঁত মুখ ভেঙে দেব না!"
       ওই মেয়েটি এবার তাকে ইংরেজিতে গালি দিল,"প্রস্টিটিউট!এবার মারতে আয় দেখি।যদি তোর হাত দুটো দুমড়ে মুচড়ে না দিই।"
       তার ওই কথা শুনে মেয়েটি তখন ভীষণ ক্রোধে তার দিকে আবার এগিয়ে যেতে গেল,"তোকে এই ট্রেনের মধ্যেই মেরে সাট করব।দেখি তুই আমার কি করতে পারিস।"
      সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রমহিলাটি তাকে ফের ধরে নিল। তার কাছে তাকে যেতে দিল না।নিয়ে ওই মেয়েটিকে বকতে লাগল,"তুমি চুপ করতে পারছ না!"
       ওই মেয়েটি তার উত্তরে ভদ্রমহিলাটিকে বলল,"কেন চুপ করব?দেখলেন না,প্রস্টিটিউটটি কেমন করে আমাকে মেরে গেল?"
       "কথাটি বলা যে তোমার অন‍্যায় হয়েছে।" ভদ্রমহিলাটি তাকে তখন বলল।
      "আমার কিছু অন‍্যায় হয়নি।এরা এই ধরনেরই মেয়ে,বুঝলেন?আমরা মানুষ দেখলে চিনতে পারি।"
      মেয়েটি তখন ভদ্রমহিলাটিকে বলল,"ম‍্যাডাম,আপনি ওকে সাবধান করে দিন!এবং চুপ করতে বলুন!নাহলে কিন্তু----"
      ভদ্রমহিলাটি ওই মেয়েটিকে তখন বলল,"তুমি চুপ করো!"
      সে চুপ করল না।বরং সরাসরি মেয়েটিকে সে বলল,"আমি চুপ করব না।তার কি বলছিস,প্রস্টিটিউট!"
      সেই তখন থেকে সে মেয়েটিকে ইংরেজিতে গালি দিয়েই চলেছে।কিন্তু মেয়েটি একবারও একটি ইংরেজি শব্দ ব‍্যবহার করেনি।এবার সে ব‍্যবহার করল,"prostitute!I am not prostitute.I am a good-charactered woman.But you are not.So your mother is prostitute.your father is prostitute.And your brother and sister  prostitute।..."অনবরত সে ইংরেজিতে গালি দিয়েই চলল।তার ইংরেজি গালির কাছে সে দাঁড়াতে পারল না।সাধারণ চেহারার এবং সাধারণ পোশাকের মেয়েটির মুখে ইংরেজি গালি শুনে ওই মেয়েটি এবার আপনি থেমে গেল।তাকে এবার আর কাউকে থামতে বলতে হল না।যদিও থামবার আগে সে একটি মৃদু প্রতিবাদ করল,"খবরদার! তুই আমাকে যা খুশি বল।কিন্তু আমার মা-বাবা এবং দাদা-দিদিকে এর মধ্যে একদম টেনে আনবি না,বলে দিলাম।"
       সাধারণ চেহারার এবং সাধারণ পোশাকের মধ্যেও যে অনেক আগুন লুকানো থাকে মেয়েটি তার প্রমাণ দিল।


                                           চার


  বাচ্চাটি মেয়েটির কোলে এখনও কাঁদছে। এখনও তার কান্না থামেনি।কারণ তার পেটে যে এখনো খাবার পড়েনি।সুতরাং বাচ্চাটির কান্না দেখে ভদ্রমহিলাটি বলল,"ইস্,বাচ্চাটির খুব খিদে পেয়েছে!"
     "হ‍্যাঁ,খুব খিদে পেয়েছে।তা-ও দেখুন,বাচ্চাকে স্তন পান করাতে পারছিনা।কারণ----"
     "কারণ?"
     "কারণ আমার স্তন পান করানো বারণ আছে। ডাক্তার বাবু বারণ করেছেন।ডাক্তার বাবুর পরামর্শ মতো তাই প্রথম থেকেই কৌটোর দুধ খাওয়াচ্ছি।"
      "ডাক্তার বাবু বারণ করেছেন কেন?"
      মেয়েটি তখন বলল,"এর আগে আমার চারটে সন্তান হয়ে মারা গেছে।তা-ও আবার সব গুলোই কচি অবস্থায়।বারবার এরকম কেন হচ্ছে?কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে আমার স্তনের দোষ আছে।ডাক্তার বাবু তাই কঠিন ভাবে বারণ করে দিয়েছেন,আমি যাতে কখনোই বাচ্চাকে স্তন পান না করাই।তাহলে বাচ্চা মারা যাবে।আগের বাচ্চা গুলো যেভাবে মারা গেছে।তাই বাচ্চাকে স্তন পান করাই না।কিন্তু দেখুন,মানুষ সেটা না জেনে বুঝে অন‍্য রকম মন্তব্য করে মনে কষ্ট দিচ্ছে।"
      ভদ্রমহিলাটি বলল,"তোমার সমস্যা আমি ঠিক বুঝেতে পেরেছি।কিন্তু তুমি এখন কি করবে?"
     "সেটাই তো ভাবছি,আমি এখন কি করব?"
      একটু ভেবে ভদ্রমহিলাটি বলল,"তুমি একটা কাজ করো।এদিক ওদিক একটু ঘুরে দেখো। কারো না কারো কাছে একটু দুধ ঠিকই পেয়ে যাবে।নাহলে বাচ্চাটা যেভাবে কান্না করছে মারা যাবে তো।"
     সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটির চোখে জল চলে এল,"না,অমন কথা বলবেন না।"তারপর বাচ্চাটিকে বুকে করে মেয়েটি এবার এদিক ওদিক ঘুরে দেখতে লাগল কার কোলে দুধের বাচ্চা রয়েছে।কে বাচ্চাকে দুগ্ধ পান করাচ্ছে।যার কোলে দুধের বাচ্চা দেখতে পেল তার কাছেই একটু দুধের জন্য ছুটে গেল।কিন্তু কারও কাছেই একটু দুধ মেয়েটি পেল না।দুধ নেই বলে দুধ থেকেও কেউ দুধ দিল না।ক্রন্দনরত শিশুটিকে বুকে করে মেয়েটি সারা বগি ঘুরল।কোথাও একটু দুধ না পেয়ে মেয়েটি তার জায়গায় ফিরে এসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল,"ঠাকুর!তুমি করুণা করো ঠাকুর!আমার বাচ্চাটার তুমি বাঁচিয়ে দাও।একটু দুধ কোথাও পেলাম না।কেউ দিল না।একটু দুধের তুমি ব‍্যবস্থা করে দাও,ঠাকুর!"
     বাচ্চাটি তখন কান্না করতে করতে 'খক খক' করে উঠল।মেয়েটি তখন জোর চিৎকারে কান্না করে উঠল,"ঠাকুর র র র..!"
     এরপর বাচ্চাটির খক খক বন্ধ হলে সেই বয়স্কা মেয়েটি তাকে বলল,"এতবড় বগিতে কোথাও একটু দুধ পেলে না?"
     "না।কোথাও একটু দুধ পেলাম না।দুধ থেকেও কেউ একটু দুধ দিল না আমার বাচ্চার জন্য।" কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটি বলল।
     "আশ্চর্য!কেউ একটু দুধ দিল না!এরা কি সব মানুষ!না এরা কেউ মানুষ নয়।সব মানুষের মতো। কারণ মানুষ কোনদিন এত কঠোর হতে পারে না।..."বলতে বলতে বয়স্কা মেয়েটি ভগবানকে ডাকল,"ভগবান,তুমি এই মানুষ রূপীদের উপর অভিশাপ বর্ষণ করো।দুধ থেকেও যারা দুধের এই ক্ষুধার্ত শিশুটিকে একটু দুধ দিল না তুমি তাদের উপর অভিশাপ বর্ষণ করো।কখনো তাদের উপর করুণা বর্ষণ করোনা।কখনো তাদের উপর..."অভিশাপ দিতে দিতে বয়স্কা মেয়েটি উঠে দাঁড়াল।ক্রন্দনরত বাচ্চাটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।দিয়ে মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলল,"মা,তোমরা থাকো।কোন চিন্তা করোনা।ভগবান আছেন।উনি নিশ্চয় তোমার ছেলের ক্ষুধা নিবারণ করবেন।"
     মেয়েটি তখন তাকে জিজ্ঞেস করল,"আপনি কি নেমে যাবেন নাকি?"
     বয়স্কা মেয়েটি বলল,"হ‍্যাঁ,মা।স্টেশনে ট্রেন ঢুকছে।আমি নেমে যাবো।"
     মেয়েটি তখন তাকে বলল,"আমার বাচ্চাকে আশির্বাদ করুন!"
     বয়স্কা মেয়েটি আশির্বাদ করল তৎক্ষণাৎ,"ভগবান নিশ্চয় তোমার বাচ্চার প্রতি সহায় হবেন।নিশ্চয় তিনি তোমার বাচ্চাকে দীর্ঘজীবী করবেন।"
     তার আশীর্বাদে সন্তুষ্ট হয়ে মেয়েটি বলল,"ভগবান আপনার মঙ্গল করুন!"
    "গাড়ি ঢুকে গেছে,মা।আমি নেমে যাচ্ছি।"
    "ঠিক আছে,যান।"


                                        পাঁচ

বয়স্কা মেয়েটি নেমে যাওয়ার পর ওই সিটটা এখন খালি হয়ে গেল।কিন্তু খালি থাকল না। তক্ষুনি একটি মেয়ে বসে গেল।মেয়েটি দেখতে সাঁওতাল মেয়ের মতো একেবারে কালো কুচ্ছিত। মেয়েটির এক হাতে একটি ভারি ব‍্যাগ ধরা আছে। আর এক হাতে বুকের সঙ্গে একটি বাচ্চা ধরা আছে।সিটে বসার আগে সে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল,"দিদি,এখানে কেউ আছে?"
      মেয়েটি মাত্র এক পলক তার দিকে তাকিয়ে দেখে বলল,"কেউ নেই।বসো।"
      মেয়েটি অমনি সিটে বসে গেল।বসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুকের বাচ্চাটিকে সে স্তন পান করাতে লাগল।স্তন পান করানোর সময় কাপড় দিয়ে নিজের বুক ভালো করে ঢেকে নিল।যাতে তার স্তন পান করানো কেউ দেখতে না পায়।পান করাতে করাতে একটি স্তন পান করানো হয়েছে ওইসময় মেয়েটির বাচ্চাটি ফের খক খক করে উঠল। আগের বারের মতো মেয়েটি তখন আবারও কেঁদে উঠে ঠাকুরকে ডাকল,"ঠাকুর র র র...!"
     কালো মেয়েটি এবার তার বাচ্চার মুখ থেকে তাড়াতাড়ি করে স্তন ছাড়িয়ে নিয়ে মেয়েটির প্রতি ব‍্যস্ত হয়ে পড়ল,"আপনার বাচ্চার কি হয়েছে ,দিদি?" 
      মেয়েটি ক্ষোভে,দুঃখে কোন কথা বলল না। তার চোখ থেকে শুধু জল ঝরে পড়ল।
      মেয়েটি কথা না বললে পরে কালো মেয়েটি ফের তাকে জিজ্ঞেস করল,"আপনার বাচ্চার কি হয়েছে,দিদি?"
      মেয়েটি বলল,"শুনে কি করবে?"
      "বলুন না,শুনি!"
      "শুনবে তো শোনো তাহলে।"মেয়েটি পুরো ঘটনাটা কালো মেয়েটিকে শোনাল।শোনার পর কালো মেয়েটি বলল,"আমি যদি আপনার বাচ্চাকে স্তন পান করাই আপনার কোন অসুবিধা আছে?আমার স্তনের কোন দোষ নেই।"
      মেয়েটি চোখ মুছে বলল,"কোন অসুবিধা নেই। তুমি আমার বাচ্চাকে তোমার স্তন পান করাও।"
       কালো মেয়েটি তখন বলল,"জাতে আমি বাগদি।বাগদি মেয়ের স্তন পান ক‍রলে আপনার বাচ্চার জাত যাবেনা তো?"
      মেয়েটি বলল,"না,জাত যাবে না।জাত যাবে কেন?তুমিও মা আমিও মা।তুমিও মেয়ে আমিও মেয়ে।তুমিও হিন্দু আমিও হিন্দু।তুমিও ঠাকুরের পুজো করো আমিও ঠাকুরের পুজো করি।জাত যাবেনা।তাছাড়া আমার কাছে এখন জাত বাঁচানোর চাইতে আমার বাচ্চার জান বাঁচানো অনেক বেশি জরুরি।তুমি আমার বাচ্চাকে স্তন পান করাও,বোন।"
      আর একটুও দেরি করল না কালো মেয়েটি। সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাটিকে সে তার কোলে চাইল,"বাচ্চাটি আমার কোলে দিন!"
     মেয়েটি বাচ্চাটি তার কোলে দিল,"নাও বোন,তাড়াতাড়ি তোমার স্তন পান করাও।"
      কালো মেয়েটি এবার বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে স্তন পান করাতে লাগল।যে স্তনটা তার বাচ্চাকে পান করানো হয়নি।কিন্তু এবার সে কাপড় দিয়ে তার বুক ঢাকল না।সবাইকে দেখিয়ে প্রকাশ‍্যে স্তন পান করাল।তাদেরকে দেখাল,দেখ।তোরা একটু দুধ দিস নি যে বাচ্চাটিকে আমি তাকে কেমন করে স্তন পান করাচ্ছি।তাদের চরম লজ্জা দিল।
       পুনশ্চঃবাচ্চাটির এরপর আপনি কান্না থেমে গেল।সে আনন্দে হাসতে লাগল।বাচ্চার হাসিতে বাচ্চার মা মেয়েটিও হাসল।স্তন পান করালো যে সেই কালো মেয়েটিও।


অনুগল্প : নিখিল মিত্র ঠাকুর


            সত্যই সেলুকাশ বিচিত্র এই দেশ
                                   নিখিল মিত্র ঠাকুর


আমাদের কত যে মানুষ রাস্তা ঘাটে, ফুটপাতে, রেল স্টেশনের খোলা প্রান্তরে শুয়ে তার সঠিক গননা হিসাব সরকারের কাছেও নেই। কারো বস্ত্র একে বারেই নেই দেহে, কারো কারো লজ্জা ঢাকার মতো বস্ত্র টুকু আছে। সারাদিনে তারা যে কতো মানুষকে দাও দাও করে চেয়ে থাকে নিজেরাও দিনের শেষে হিসেব মেলাতে পারে না।
অধিকাংশ মানুষ কপালে হাত ঠেকিয়ে চলে যায়, কেউ কেউ মুখ খেচিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে। ভালো কেউ নেই, ভালো কেউ তাদের বাসে না। বোধহয় তাদের জীবন এই পথেয় নির্ধারিত।
কিন্তু আমরা যদি ভেবে দেখি তাহলে খুব সহজে সমস্যা সমাধান করা যায়। আমাদের দেশের লোক সংখ্যা একশো ত্রিশ কোটী। অথচ নিঃসম্বল মানুষদের সংখ্যা খুব বেশি হলে দুই থেকে তিন কোটী হবে। ব্যাপারটা আমাদেরকে পাচজনকে হয়তো তাদের একজনের দায়িত্ব নিতে হবে। খুব সহজেই এটা পালন করা যায়।
আজকাল কিছু সেচ্ছাসেবী সংগঠন এই সব হতভাগ্য মানুষদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র বিতড়নের ব্যবস্থা করতে শুরু করেছে। এটা যে একটা শুভ প্রচেষ্টা সে বিষয়ে কারো কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। কিন্তু এই প্রচেষ্টা প্রয়োজনের বেশ অপ্রতুল। আরো অনেক মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।
আমরা ভারতীয়রা জন্মগত ভাবে উদার। আমরা লুটেরা হুন, বর্গী, পাঠানদের বুকে টেনে নিয়েছি,আমরা অত্যাচারী ইংরেজদের বুকে টেনে নিয়ে শত শত বৎসর দেশ লুট করতে সাহায্য করেছি। 
আমি এখন বেশ কিছুদিন রয়েছি কোটা শহরে। সকালে একটু শীত শীত ভাবটা কমলে প্রতিদিন বিভিন্ন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন বেড়াতে গিয়ে দেখি বিভিন্ন মানুষ দামী গাড়ির পিছনে সবুজ ঘাস নিয়ে রাস্তায় যত জায়গায় গোরু দেখতে পাচ্ছে সেখানে সেখানে দাড়িয়ে ঘাস খেতে দিয়ে যাচ্ছে। গোরু গুলো সকালে এত খাবার পাচ্ছে যে তাদের মাঠে না গেলেও সুন্দর সারাদিন চলে যাবে।
গোরু গুলোকে খাবার না দিলেও তারা মালিকের কাছে খাবার পাবেই। কিছু মানুষের মালিক খুব নিষ্ঠুর। তিনি প্রক্ষিপ্ত করার পর ভালো থাকার পথের সন্ধান সন্তানদের দেন না। যাইহোক, গোরুকে খাবার দিলে বেশি পুণ্য হয়, না নিঃস্ব মানুষদের খাবার দিলে বেশি পুণ্য হয় তা আমার জানা নেই। কিন্তু এটা জানি পথ মানুষেরা এটা দেখলে বলবে মানুষ না হয়ে গোরু হলে ভালো হতাম। আমার গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের একটা কথা মনে পড়ছে " সত্যই সেলুকাশ বিচিত্র এই দেশ"।


প্রবন্ধ : শঙ্কর ব্রহ্ম



                             প্রসঙ্গ: কবিতা ভাবনা
                                  শঙ্কর ব্রহ্ম


এক.

"কবি কোন তকমা নয় 
কবি বিশেষ এক পরিচয়,
মনের ভাব যার কথায়
ছন্দে চিত্রে প্রকাশ পায়।"
                    সব বিদ্যে শেখানো যায়,
কবিতা লেখা শেখানো যায় না।
                       ওটা যার হয় তার হয়,
ভিতরের ব্যাপার( অনুভূতির তীব্র আবেগে, প্রকাশের তাগিদ)।
    তবে আজকাল বানানো কবিতার ছড়াছড়ি,চোখে পড়ে যার মধ্যে প্রাণের স্পর্শ পাওয়া যায় না।
        কবিতা আসে স্বতস্ফূর্ত ভাবে,
ছন্দ মাত্রা তাল লয় ভেবে আসে না।
কবি অনেক সময় তা নিয়ন্ত্রণ করে,
তার জ্ঞান বুদ্ধি শিক্ষা দিয়ে,কবিতা সে নিয়ন্ত্রণে,অনেক সময় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
ভিতরে কবিত্ব বোধ থাকলে তবেই হবে
নতুবা সবটাই যাবে ফাঁকি।
      বিদেশে কবিতা লেখা শেখাবার কিছু স্কুল আছে,সেখানে লেখা শিখে কেউ বড় কবি হতে পেরেছেন বলে শোনা যায়নি।
                কবি সুনীল গাঙ্গুলী ,সমরেন্দ্র সেনগুপ্তরাও কলকাতায় সে রকম একটা প্রচেষ্টা করেছিলেন ,কৃত্তিবাস পত্রিকার পক্ষ থেকে , সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি।
   তারা কোন সৃষ্টিশীল কবি তৈরী করতে পারেননি,সেই পরিকল্পনা থেকে,ফলে তা অল্পকালের মধ্যেই পরিত্যাজ্য হয়।
             ফরাসী কবি মালার্মে বলেছেন ,
কবি আসলে নিজের সাথে কথা বলে,
পাঠক শ্রোতারা আড়ি পেতে তা শোনেন।

দুই.


দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে কবিতার সঙ্গে সহবাস আমার,তবু কতটুকু বুঝতে বা জানতে পেরেছি তাকে?
               স্পষ্ট করে বলতে পারব না।
সে আজও আমার কাছে সম্পূর্ণ রহস্যময়,
আগের মতো সমান আকর্ষণীয়।
                     তবু যতটুকু বুঝেছি তাকে,
তা নিয়ে কিছু বলাটা বোধহয় অসমীচীন হবে না।
         অন্য কোন কবির, কবিতা লেখার পদ্ধতির কথা জানি না।
    তবে, নিজের লেখার পদ্ধতি নিয়ে কিছু কথা বলতে পারি,যা একান্ত ব্যক্তিগত,যদি কারও কোন উপকারে আসে, তাই বলা।
          আমি কোন কবিতা লিখি না,বরং কবিতাই আমাকে দিয়ে কিছু লিখিয়ে নেয় ,কেমন করে তাও বলি শুনুন।
    এক একটা পংক্তি এসে কোথা থেকে মাথায় ঢুকে পড়ে, আচমকাই।
      তারপর সেটা মনে মনে লালন করার পর্ব শুরু হয়,দ্বিতীয় পংক্তির জন্য প্রার্থনা চলে,মনে মনে।সেটা কখন আসবে তা কেউ জানে না।
   আমি মনেকরি, কবিতা লেখা পার্টটাইম জব নয়,ফুলটাইম ওয়ার্ক।নিরবিচ্ছিন্ন ব্যাপার,ভোরে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা থেকে শুরু হয় ,তারপর ঘুমের আগে অবধি চলে কবিতা সৃজনের কাজ মনে মনে।ঘুমের ভিতরও অনেক সময় চলে স্বপ্নে।
       অনেক সময় মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে,হঠাৎ একটা পংক্তি এসে বিরক্ত শুরু করে,সকালে উঠে আর সেটা মনে থাকে না,তাই আমি তখনই পংক্তিটি লিখে রাখার চেষ্টা করি আজকাল।হাতের কাছে যা পাই তাতেই লিখে রাখি তখনকার মতো,প্রেসক্রীপশনের উল্টো পিঠে, ক্যালেন্ডারের ছেঁড়াপাতায়,লন্ড্রির বিল,কিংবা কিছু কেনাকাটার রসিদ ইত্যাদি হাতের কাছে যা পাই তাতেই।
      সকালে উঠে, প্রাত্যহিক কাজ-কর্ম সেরে,চায়ে চুমুক দিতে দিতে,পংক্তিটি মনে মনে আওড়াই বার কয়েক।
         ভিতরে ভিতরে কবিতাটি লেখার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় মনে মনে।
      সব সময় সফল হই তা নয়, প্রায়শই বিফল হই,কখনও সখনও সফলতা আসে তার অনুগ্রহ পেলে।লেখাটা পূর্ণতা পায়।
       নিজের মনপূত না হলে, তার উপরও  কাঁটাকাটি চলে,যতক্ষণ না পর্যন্ত মন
তুষ্টি হয়।এইভাবেই আমার কবিতা লেখার প্রক্রিয়া চলে,বলা যায়।
      কবিতার নিজস্ব একটা ভাষা আছে , তা আয়ত্ব করতে বহুদিন সময় লাগে,
দেশী বিদেশী ভাল ভাল কবিতা পড়তে হয় বারবার,অনুসন্ধিৎসু থাকতে হয় মনে মনে, পূর্বসূরীদের লেখা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা একান্ত জরুরী,হঠাৎ ভূঁই ফোড়ের মতো কিছু হয় না।
   ভাবতে হয় সে'সব লেখা নিয়ে নিয়মিত, দীর্ঘদিন এ'রকম প্রচেষ্টার ফলে, তা কিছুটা আয়ত্বাধীন হয়।
তারপর চলে নিজের মতো করে পরীক্ষা নীরিক্ষার কাজ।সেটা মোটেই সহজ  ব্যাপার নয় ।
হঠাৎ করে এসব আয়ত্ব করা যায় না।
যারা এ'কথা বোঝেন না, কিংবা মানেন না,তাদের কবিতা লেখার প্রচেষ্টা, ছন্দ মিলিয়ে পদ্য লেখা ছাড়া,আর বেশী কিছু হয় বলে আমার মনে হয় না।
        সে'রকম লেখাই আজকাল অনেক চোখে পড়ে, যাতে প্রাণের সাড়া মেলে না।
মূর্তি গড়া হয় বটে,তা কখনই প্রতিমা হয়ে ওঠে না।
      কবিতা তো তাই যা সহজেই মানুষের চিত্ত চাঞ্চল্য ঘটায়,মনে করুণার উদ্রেক করে,নর নারীর বন্ধনকে মধুর করে,এবং হিস্র যোদ্ধার মনেও সান্ত্বনা এনে দেয়।
     মানুষ কাব্যে সান্ত্বনা খোঁজে, জীবনের দিকদর্শন চায়,আনন্দ খোঁজে এই নিরানন্দময় জীবনে।আমার তো মনে হয় তাই।নতুবা পাঠক অযথা কবিতা পড়তে যাবেন কেন,আজকের এই ইন্টারনেটের যুগে,যেখানে মানসিক উপভোগের সব রকম সামগ্রীই সহজলভ্য।
     বস্তুতঃ বহু শতাব্দী ধরে এ'কারণেই, কবিতা টিঁকে আছে আজও তার নিজস্ব সত্তা ও অস্তিত্ব নিয়ে,বহাল তবিয়তে।
          এ'ব্যাপারে পাঠকদের সুচিন্তিত মতামত প্রত্যাশা করি।

তিন.

কবিতা সরাসরি কথা বলে না।কবিতা লেখা হয় সান্ধ্যভাষায়,তাই বহুক্ষেত্রে
কবিতার ভাষা ইঙ্গিতবাহী, শঙ্খ ঘোষ যাকে বলেন, কবিতার অবগুন্ঠণ।
সে ইঙ্গিত সূক্ষ্ম হতে পারে, আবার স্থুলও হতে পারে।
স্থুল ইঙ্গিত কবিতার নিয়মিত পাঠকেরা সহজেই  ধরতে পারেন,বুঝতে পারেন।
  সূক্ষ্ম ইঙ্গিত সকলের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় বলে,সে'সব কবিতাগুলো দূরহ মনে হয়, তাদের কাছে।দুর্বোধ্যতা ভিন্ন ব্যাপার।
সূক্ষ অনুভূতিতন্ত্রের লোকেরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারে সে'সব লেখা,অবশ্য তাদের সংখ্যা খুবই কম।
           কবিতা ভাষা যেহেতু ইঙ্গিতবাহী সেকারণে - রূপক,চিত্রকল্প,উৎপ্রেক্ষণ,
নিপুন শব্দ ব্যাবহারের নিপুন দক্ষতা,সব কিছুই বিশেষ ভাবে ফুটে ওঠে কবির কবিতায়।
       অবশ্য কবিতা লেখার সময় এতসব ভেবে কবিতা লেখা হয় না।লেখা যায় না।
        কবিতা লেখার পূর্বেই এ'সব নির্দিষ্ট প্রক্রিয়াগুলে চলতে থাকে নিঃশব্দে, ভিতরে ভিতরে।এইসব প্রক্রিয়াগুলো,
মানসিক ভাবে কবিকে তৃপ্ত করলে,তবেই কবিতাটি ভূমিষ্ট হবার সুযোগ পায়।
     কবি তার প্রয়োজনে ছন্দকে ব্যবহার করেন তার কবিতায়,অবশ্য সর্বদাই সে ছন্দের অনুশাসন মেনে চলবেন  এমন কোন কথা নেই।কোথায়ও ছন্দের একচুল কম বেশী হলে, তিনি গায়ে মাখেন না।কবির মূখ্য লক্ষ্য থাকে কবিতাটির সুষ্ঠ বিন্যাস।তিনি মনে করেন,ছন্দ যদি পুরোপুরি কবিতাকে শাসন করে, তবে
অনেক সময়,কবিতার স্বতঃস্ফূর্ততা নষ্ট হয়।কবিতা খর্ব হয়ে পড়ার সম্ভবনা থেকেই যায়।
       অবশ্য ছান্দসিকের সেটা মনঃপূত
না হতেই পারে, তাতে কবির কিছু এসে যায় না।
         তারা ভুলে যান, কবিতার জন্যই ছন্দ,ছন্দের জন্য কবিতা নয়।ছন্দ কবিতার বাহন মাত্র,তার বেশী কিছু নয়।
ছন্দ মানুষকে বেশী মাতাতে পারে, তার একটা চুম্বক আকর্ষ আছে,যা যে কোন প্রাণীকেই অমোঘ ভাবে টানে। তাই
কবিতায় ছন্দ অপরিহার্য না হলেও কাঙ্খিত।কারণ, তাতে সহজেই মানুষের মনে দোলা দিয়ে,কবিতার ভাব সঞ্চারে সহজ সহায়তা করে।
     কবি জীবনানন্দ দাশ মনে করতেন,
  কোন কবিতা ছন্দে লেখা হবে, তা ভিতরে ভিতরেই ঠিক হয়ে যায়,কবিতাটি ভূমিষ্ট হবার পূর্বেই।
     প্রত্যেক মনীষারই এক বিশেষ ক্ষমতা থাকে,সে তার নিজের জগতে সিদ্ধ,কবির সিদ্ধিও তার কাব্য সৃষ্টির ভিতরে।অবশ্য তার মানে এই নয় যে কবি ব্যবহারিক জীবনে অকর্মণ্য,বরং সাধারণ বুদ্ধিমান লোকের মত,সে তার ব্যবহারিক প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম।
    কবিতা মূলত লোকশিক্ষা নয়,কিংবা তাকে রসসিক্ত করে পরিবেশন নয়,তাই যদি হতো তবে "সদ্ভাব শতক"  শ্রেষ্ট কাব্যের মর্যাদা পেত,তা কিন্তু পায়নি।
  স্লোগান কিংবা কোন বাণীও সেই অর্থে কবিতা নয়।তাহলে " সদ্ভাব-শতক"কে
সকলেই কাব্যগ্রন্থ ভাবত।কি তা কেউ ভাবে না।
        সামজিক পরিবর্তেন দায় কবির নিজের ঘাড়ে না নেওয়াই বাঞ্ছণীয়।তার জন্য সমাজপতিরা রয়েছেন। কবির কাজ মজাজপতিত্বের দায় কাঁধে তুলে নেওয়া নয়।অবশ্য তার মানে এই নয় যে তিনি সমাজের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কনবেন না। অবশ্যই করবেন,
তা তার নিজস্ব ভাষার পরিমন্ডলের মধ্যে, তা কখনও, সমাজপতিদের মতো উচ্চকিত স্লোগান ধর্মী হবে না।কবি কখনই অসামজিক মানুষ নয়,ফলে তার কবিতায় সামাজিক প্রতিচ্ছবি ফুঠতে বাধ্য,সৎ কিবি কখনই সমাজ ত্যাগ করে গজদন্ত মিনারে বাস করে কবিতা লেখেন না আজকাল।তিনি আর পাঁচ জন মানুষের মতো এই সমাজেরই একজন অধিবাসী।ফলে সমাজের ভালমন্দের দায় তার উপরও বর্তায়। তিনি সমাজের সঙ্কটময় মুহূর্তে নীরব থাকতে পারেন না।
  এই জন্যই বোধহয়,দার্শনিক এরিস্টটল কবিকে সমাজের সদা জাগ্রত প্রহরী বলে
অভিহিত করেছেন।
    অবশ্য তার গুরু সক্রেটিস ভাবতেন, সমাজে কবির কোন কাজ নেই,ফলে সমাজে তার কোন স্থান নেই।অসামাজিক মানুষ তিনি। কবি শঙ্খ ঘোষ যাকে শ্লেষ করে অনায়াসে বলেছেন,"মূর্খ বড়,সামাজিক নয়"।
        কবিতা পাঠ একটা একটা সতন্ত্র রসাস্বাদনের ব্যাপার।সে স্বাদ গ্রহনের জন্য পাঠকেরও প্রয়োজন হয় মনে মনে প্রস্তুতি গ্রহনের,নতুবা তার কাছে,  সে'রসের স্বাদ অধরাই থেকে যায় আজীবন।

চার.

 কবিতায় কবি কথা বলে।
                  কিন্তু কার সঙ্গে কথা বলে?
কবি মালার্মে কথিত, শুধু নিজের সঙ্গে?তাই যদি হবে, তবে কবি আর পাগলের বিশেষ তফাৎ থাকে না। একটা তফাৎ থাকে অবশ্য। পাগল নিজের সঙ্গে কথা বলেই তার কর্তব্য সম্পাদন করে। পাগলকে তা লিখে রাখতে হয় না।
      কবিকে তার কথা লিখে রাখতে হয়। কেন লিখে রাখতে হয় তবে?
             কাউকে শোনাবার জন্যই তো?
কিন্তু কেউ শুনবে কেন,তার আবোল তাবোল বলা কথাগুলো,যদি না তাতে পাঠকের মনে রস সঞ্চার হয়? যদি না তার অুনুভূতি তন্ত্রীতে আলোড়ন তোলে?
       তাহলে শেষ পর্যন্ত কথাটা দাঁড়াচ্ছে, কবি নিজের সঙ্গে কথা বললেও,সে চায় তার কথাগুলো পাঠকের দরবারে পৌঁছে দিতে।তাই সে কথাগুলো লিখে রাখে,ছাপতে দেয়।
     পাগলের সে সব কোন দায় থাকে না।
তবে কবিকে পাগল না বললেও বাতুল বলা চলে।
     কবি অনেক কথা বানিয়ে, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বেশী করে বলেন। আর তা করতে গিয়েই তাকে কবিতার ভাষার আশ্রয় নিতে হয়। আশ্রয় নিতে উপমা, চিত্রকল্প,ছন্দ, রূপক,উৎপ্রেক্ষণ,
ইঙ্গিতময় সান্ধ্যভাষার।
           আগেই বলেছি,কবিতার একটা নিজস্ব ভাষা আছে, সে ভাষা দীর্ঘদিন প্রচেষ্টায় রপ্ত করতে হয়। সে ভাষা
ইঙ্গিতময় এবং কথ্যরীতিতে বলা চলে,
   শঙ্খ ঘোষ যাকে বলেছেন,বাকছন্দ।
              কার কাছে কবিতা কি ভাবে আসবে,সেটা নির্ভর করে কবির ব্যক্তি সত্তার উপর।
তার মানসিকতা, রুচি,পাঠাভ্যাস,অধিত বিদ্যা,প্রিয় কবির প্রভাব,পারিপার্শিক পরিস্থিতি,সহযোগী সঙ্গ যাপন প্রভৃতি জটিল প্রক্রিয়ার উপর।
   একটা রহস্যময় ব্যাপার,য্ কোন কবিই বোধহয় পুরোপুরি ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে
পারেন না। কারণ তারা নিজেরাও বোঝেন না সবটা পুরোপুরি এই কুহেলিকার।
    কেউ কেউ, মালার্মের মতো মনে করেন, কবিতা শুধু কবির নিজস্ব অনুভূতির উন্মেষ,সেই কবিতা পাঠকের বোঝার ব্যাপারে,কবির কোন দায় নেই।
   এ'কথা শুনতে যতোই কাব্যিক মনে হোক, পুরোপুরি মানতে দ্বিধা হয়।
    পাঠকের প্রবেশের জন্য দরজা জানলা খোলা না থাকলে,পাঠকেরও কোন দায় থাকে না, সে বদ্ধ গুদামে প্রবেশের।
    কবিতায় কবি নিজের সঙ্গে যতই না কথা বলুক,তার একটা সংযোগ যদি পাঠকের সঙ্গে না ঘটে, তবে পাগলের প্রলাপ ছাড়া, তাকে আ র বেশী কিছু বলা চলে না। পাগলও নিজের সঙ্গে কথা বলে,কারও কোন দায় থাকে কি সে কথা শোনার?
   কবির লেখা যদি পাঠকরা পড়ে কিছুই না বুঝতে পারে,তবে তারা আগ্রহ বোধ করবে কেন কবিতা পাঠে? তবে সে লেখার সার্থকতা কোথায়?
   এই প্রসঙ্গে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের
সঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের পত্রালাপ মনে পড়ছে।
    কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত চাইতেন, পাঠকের অলস মনের জড়তা কাটাবার জন্য কবিতায় অপ্রচলিত শব্দের ব্যাবহার। তার যুক্তি ছিল, শব্দবাধায় ঠোক্কর খেয়ে, অনেকেই হয়তো ঘরে ফিরবে,কিন্তু তার পরেও যারা এগোবে,তারা অন্তত চলবে চোখ খুলে,কান মেলে প্রতি অগ্র পশ্চাৎ উর্ধ্ব অধঃ দেখতে দেখতে। এখানে অলঙ্কারের কথাও বলে নিই কেননা অলঙ্কার চিন্তাকে পরিস্ফূট করার বিশেষ সহায়। উপমানের সঙ্গে উপমার এত নিবিড় সম্পর্ক যে প্রথমটির স্বভাব অন্তত আংশিক ভাবে হলেও এসে পড়ে। কাজেই উপমার ভিতরেও একটা সামঞ্জস্য,একটা ন্যায় সঙ্গতি না থাকলে মুস্কিল।কিন্তু তাই বলে উপমাগুলিকে গতানুগতিক হতে হবে তার কোন মানে নেই, বরং উল্টোটাই ভালো।সত্যকে নতুন ভাবে দেখতে গিয়ে নূতন রূপকের দরকার হওয়া স্বাভাবিক।
    তিনি আরও বলেছেন, যারা কবিতাকে ছুটির সাথী বলে ভাবে,কবিতার প্রতি ছত্র পড়ে হৃদকম্পন অনুভব করতে চায়, তাদের কবিতা না পড়াই উচিৎ।কবিতার গঠন যেমন প্রত্যেক লাইন বিশ্লেষণ করে ধরা যায় না, তার ভাবাবেশও তেমনি খন্ডাকারে দেখা যায় না,বিরাজমান থাকে সমগ্রের মধ্যে।
    ভাব শুধু মেঘ বাঁশি প্রিয়া বিরহ মিলন
ইত্যাদি জরাজীর্ণ শব্দের করতলগত নয়,শুধু প্রেম বেদনা ও প্রকৃতিকে নিয়েই কাব্যের কারবার চলে না,তার লোলুপ হাত দর্শন- বিজ্ঞানের দিকেও আম্তে আম্তে প্র প্রসারিত হচ্ছে।
   এই " বিশেষ জ্ঞানে"র দিনে কাব্যের তরফ থেকে আমি পাঠকের কাছে,সেই নিবিষ্ট ভিক্ষা করি যেটা সাধারণ অর্পিত হয় অন্যান্য আর্টের প্রতি।
   বুদ্ধিমান অধ্যাবসায়ী পাঠকদের জন্য কবিতা লিখতেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত।
          রবীন্দ্রনাথের এ'মতে সায় ছিল না।
তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে জানিয়ে ছিলেন,
" মানুষের মধ্যে, যে লোকটা বুদ্ধিমান তার দাবীর দিকে না তাকিয়ে, যে লোকটা রসবিলাসী তাকে খুশি করার চেষ্টা কর।
বুদ্ধিমানদের জন্য আছেন আইনস্টাইন,
ব্রার্টান্ড রাসেল,প্রশান্ত মহালনবিশ,সুনীতি চাটুজ্জে মস্ত মস্ত লোক সব।"
           অথচ তিনি পাঠকরুচির কাছে আত্মসমর্পণের ঘোর বিরোধী ছিলেন।তাতে সস্তা সাহিত্যের আমদানী ঘটে এ'বোধ তার তীব্র ছিল।তার ভাষায়, "আদর্শ রক্ষা করতে গেলে প্রায়াসের দরকার,সাধনা না হলে চলে না।"
         কবি জীবনানন্দ দাশের কথায়,
" কাব্যে কল্পনার ভিতর,চিন্তা ও   অভিজ্ঞতার সারবত্তা থাকবে।"
     চিন্তা ও চেতনার কবির যেমন এক নিজস্ব জগৎ আছে।বাস্তব অভিজ্ঞতাও
তার চিন্তা চেতনাকে আলোড়িত করে, প্রভাবিত করে,এবং কবি তা প্রকাশ করেন,তার নিজস্ব কল্পনার মাধ্যমে।
এবং সে কল্পনাকে জাগরুক করতে হলে, তাকে আশ্রয় নিতে হয়,কখনও চিত্রকল্পের,কখনও রূপকের,কখনও উৎপ্রেক্ষণের,কখনও ছন্দ মাধুর্যের,কখনও ইঙ্গিতময় সান্ধ্যভাষার, কখনও যথার্থ শব্দ ব্যবহারের দক্ষতার।সব মিলিয়েই কবিতাটা রূপ পরিগ্রহন করে শেষ পর্যন্ত।
    এ'সব অনুভবের ব্যাপার,ব্যাখ্যা করে বোঝাতে গেলে,ভুল বোঝার সম্ভবনা থেকে যাবে, ঠিক মতো বোঝানো সম্ভব হবে না, হয় তো!
           কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেন,
" শব্দকে ব্রহ্ম বলা হয়।কবিতায় কথাই সব।কথায় কি না হয়? কবিতায় কথা মন্ত্রের মতো কাজ করে।কথার নড়চড় হলে কবিতা একদম দাঁড়ায় না।শব্দের মূল তত্ত্বের মধ্যেই নিহিত আছে কবিতার মূল কথা।কেননা,শব্দই হল কবিতার মূলাধার।"
বস্তুত,শব্দ বাছাইয়ের পার্থক্য থেকেই এক কবিকে অন্য কবির থেকে আলাদা করে চেনা যায়।মরা শব্দকেও ব্যবহারিক পারদর্শিতায় কবি জ্যান্ত করে তোলেন।
    যথার্থ কবির কাছে কথার খেলাই কবিতা হয়ে ওঠে, যা ম্যাজিক সৃষ্টি করতে পারে পাঠকের মননে।
        কথাটা যত সহজে বললাম আমি,
কাজটা মোটেই তত সহজ নয়, বরং কঠিন দূরহ ব্যাপার।তার জন্য প্রয়োজন হয়,রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, " কঠিন সাধনার"।
  অনেক সাধনার ফলে, সিদ্ধি লাভ করা সম্ভব হয়। মহৎ চালাকির সাথে ফাঁকি দিয়ে এই কাজ সম্ভব হয় না।

পাঁচ.

বিশেষ প্রকারের আনন্দ দেওয়াই কবিতার প্রধান কাজ।কবিতা পাঠের আনন্দ আর অন্য পাঁচ রকমের আনন্দ থেকে আলাদা,বুঝতে হবে।আর তা না হলে, সাধারণ আমোদ প্রমোদ বা কবিতা পড়ার আনন্দের মধ্যে কোন তফাৎ থাকে না।কবি ওয়ার্ডওয়ার্থ ও কোলরিজ কবিতা পাঠের আনন্দের মধ্য দিয়েই তার লক্ষণ বিচার করেছেন।তবে তারা কবিতা পাঠের আনন্দকে অন্যান্য আনন্দ থেকে আলাদা করে দেখাননি।ফলে,সমালোচনার হাত থেকে তারা রেহাই পাননি।
     টলস্টয়ের মতে,"কবিতার কাজ যদি শুধু আনন্দ দানই হয়,তবে তাকে নৈতিকতার দিক থেকে কোন গৌরবের বস্তু মনে হয় না।কিংবা ট্রাজেডি যে ধরণের আনন্দ আমাদের দেয়, তাকে তো সাধারণ অর্থে আনন্দ বলা যায় না। পরের দুঃখে আনন্দ পাওয়া কোন গৌরবের বস্তু নয়।"
     এই বিপর্যয় এড়াবার জন্য, গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল বললেন,ট্রাজেডিতে একধরণের বিশেষ আনন্দ আছে।কিন্তু সেই বিশেষ আনন্দ কি,তা আবার তিনি ব্যাখ্যা করেননি। দার্শনিক কান্টও,এই বিশেষ আনন্দের দ্বারা কাব্যর লক্ষণ বিচার করেছেন।সে আনন্দ-ইন্দ্রিয়জনিত সুখ,জ্ঞান ভিত্তিক কিংবা নীতি মূলক আনন্দ হতে পারে।সুতরাং কবিতা আমরা পড়ি,তা থেকে বিশেষ ধরণের আনন্দ পাই বলেই। কবি লংগাহনাস,কবিতা পাঠে,
"তূরীয় আনন্দের"কথা বলেছেন।আলংকারিক অভিনবগুপ্ত এই আনন্দকে
' অলৌকিক চমৎকার ' বলেছেন।অন্য ভারতীয় আলংকারিকরা এই আনন্দকে,
'ব্রহ্ম স্বাদ সহোদরা' আখ্যা দিয়েছেন।এর দ্বারা মনন তৃপ্ত হয়।
    আর এই অলৌকিক আনন্দ সৃষ্টি করেন কবিরা,ভাষার মাধ্যমে। এই জন্যই বোধহয় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবিদের বলেছেন "ভাষার যাদুকর"।
     কবি কবিতায় শুধু শব্দের অর্থ জ্ঞাপনের কাজটি করে সন্তষ্ট হতে পারেন না,তিনি শব্দের ধ্বনির সাহায্য নেন তার ভাব প্রকাশের জন্য,কবিতায় চমৎকারিত্ব সৃষ্টির জন্য।
    এ তো গেল, কবিতায় আনন্দ দানের দিকটির কথা।
   অন্যদিকে,কবি কীটস কবিকে 'সত্য ও সুন্দরের ' পূজারী বলে আখ্যা দিয়েছেন।ররীন্দনাথেরও এ'মতে সায় ছিল।
গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল কবিকে বলেছেন "সমাজের জাগ্রত প্রহরী"। অথচ তার গুরু সক্রেটিস বলেছেন,সমাজে কবির কোন ভূমিকাই নেই।সে সমাজে অপাংতেয়।সমাজে তার কোন দরকার নেই।সমাজ থেকে তাকে বহিষ্কার করা উচিৎ।
   অথচ ভারতীয় ঋষিরা কবিকে এমন উচ্চ মর্যাদায় স্থান দিয়েছিলেন যে তারা মনে করতেন," কবিতা পাঠে ঈশ্বর প্রাপ্তির স্বাদ অনুভব যায়।"
   কবিতা পাঠে সত্য ও সৌন্দর্যের উপলব্ধিতে, যে আনন্দ পাওয়া যায় সে আনন্দ বিশেষ ধরণের আনন্দ ,সাধারণ বা লৌকিক আনন্দ থেকে তা পৃথক,তা হল জ্ঞান উপলব্ধির আনন্দ।
   ফরাসী কবি মালার্মে বলেছেন,কবি নিজের সাথে কথা বলে,আমরা পাঠকরা তা আড়ি পেতে শুনে,মজা বা আনন্দ পাই, আর তাই বলেই তা শুনি।কবির কাজ নয় তা শোনানো।
কবি জীবনানন্দ দাশ মনে করতেন,কবিরা যখন ভাবাক্রান্ত হন তখন কবিতা লেখেন, আবার কবি বিষ্ণু দে বলেন,'সংবাদ মূলত কাব্য'।
  ধ্বনিকার আনন্দবর্ধন মনে করেন, কবিতায় শব্দ এমন ভাবে ব্যবহার করা হয় যে তাদের বাচ্যার্থের মধ্য দিয়ে এবং তাকে ছাড়িয়ে একটি ব্যঞ্জনার্থ প্রকাশিত হয়,যা কাব্যের প্রধান অর্থ হয়ে চিত্তকে দোলা দেয়,একটা চমৎকারিতার আস্বাদ দেয়।শরীরের লাবণ্য যেমন,শরীরের ভিতরেই প্রকাশিত হয়েও তা শরীর অতিক্রম করে একটি সতন্ত্রভাব বস্তু রূপে প্রতিভাত হয়,কাব্যের ধ্বনি সেই ভাবেই কবিতায় উপস্থিত হয়।ভাবকে রসে উন্নীত
করতে হলে, শব্দের বাচ্যার্থের চেয়ে,
তাদের ব্যাঞ্জনার্থের বেশি সাহায্য নিতে হয় তবুও এই রসই সেই কাব্যানন্দের স্বরূপ।
  এত সব বিবেচনা করে অবশ্য কোন পাঠকই কবিতা পড়েন না।যারা কবিতা পড়েন তারা কবিতা পড়ে কিছু পান বলেই কবিতা পড়ে থাকেন বলে আমার মনেহয়।


প্রবন্ধ: সিদ্ধার্থ সিংহ



                                    বসন্ত মানেই দোল
                                          সিদ্ধার্থ সিংহ


শ্রীকৃষ্ণ তখন একেবারেই বালক।  সারা গোকুল তার দুষ্টুমিতে অস্থির। গোপিনীরা মাথায় হাঁড়ি করে ননি নিয়ে হাটে যেতে ভয় পায়, কখন দলবল নিয়ে সে হামলা চালায়! তবু সকলের কাছেই সে ছিল নয়নের মণি।
কিন্তু অন্যান্যদের তুলনায় গায়ের রং একটু চাপা হওয়ায় তার মনে নিশ্চয়ই একটা কষ্ট ছিল। তাই একদিন সে তার পালিকা মাকে বলেই ফেলল, মা,  রাধা-সহ সব গোপিনীরাই এত ফরসা, কিন্তু আমার রং কালো কেন?
এ কথা শুনে মা যশোদা ঘর থেকে কিছুটা আবির এনে তার সারা গায়ে মাখিয়ে দিলেন এবং বললেন, যাও, এই আবির সবাইকে মাখিয়ে দাও। তা হলে কেউ আর কালো বা ফরসা থাকবে না। সবাই সমান হয়ে যাবে।
মায়ের কথা শুনে সে সঙ্গে সঙ্গে ছুটল গোপিনীদের আবির মাখাতে। ব্যাস, সবাই মজা পেয়ে গেল। আর সেই যে শুরু হল,  তার পর থেকে সেই দিনটাই চিহ্নিত হয়ে গেল সবাই সবাইকে আবির মাখানোর দিন হিসেবে। আর সেই জায়গাটাও নির্দিষ্ট নির্দিষ্ট হয়ে গেল দোলমঞ্চ হিসেবে। যত দিন গেল গ্রামে গ্রামে গজিয়ে উঠতে লাগল নতুন নতুন দোলমঞ্চ। যেহেতু সেই দিনটা ছিল পূর্ণিমা, তাই সবার কাছে সেটা হয়ে গেল দোল পূর্ণিমা। মানে ফাল্গুনি দোল পূর্ণিমা।
শুধু এ দেশেই নয়, এশিয়া মহাদেশের নেপাল, দক্ষিণ আমেরিকার সুরিনাম,  উত্তর আমেরিকার ত্রিনিদাদ ও  টোবাগো, ওশেনিয়া অঞ্চলের ফিজি, আফ্রিকা মহাদেশের মরিশাস ছাড়াও যেখানেই ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা আছেন,  সেখানেই জাঁকজমক করে প্রতি বছর পালন করা হয় দোল উৎসব। দক্ষিণ আমেরিকার গায়ানাতে তো দোলটা  আবার রীতিমত জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের সময়ে দোল অন্য মাত্রা পায়।  নাচ,  গান, আবৃত্তি,  নাটক এই উৎসবের অঙ্গ হয়ে ওঠে। আজও প্রতি বছর দোলের দিন সকালবেলায় প্রভাতফেরি বের করে আশ্রমিকেরা। তারা দল বেঁধে--- ‘ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল লাগল যে দোল' গানটি গেয়ে বসন্তোৎসবের সূচনা করে। সন্ধ্যাবেলায় গৌরপ্রাঙ্গণে কবিগুরুর কোনও না কোনও নাটক মঞ্চস্থ হয়।তা দেখতে শুধু এ দেশের নানা কোণ থেকেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এসে ভিড় করে।
চোদ্দোশো এক সালে বাংলাদেশেও রঙের উৎসব শুরু হয়। সেই থেকে আজও ‘জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ’ প্রত্যেক বছর খুব ঘটা করেই আয়োজন করে এটা।  যদিও এখন তার আঁচ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের অন্যত্রও।
এক সময় শুধু আবিরই ব্যবহার করা হত। বলা হত,  আবির গায়ে মাখলে নাকি বসন্ত রোগের প্রকোপ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। কিন্তু যত দিন গড়িয়েছে,  মানুষ ততই আবিরের বদলে ব্যবহার করতে শুরু করেছে বালতিতে গোলা রঙিন জল। ব্যবহার করা শুরু করেছে পিচকারি। যাতে কেউ রং দেখে ছুটে পালাতে গেলেও দূর থেকেই তাকে রাঙিয়ে দেওয়া যায়। যিনি রং মাখতে চান না,  তাকে জোর করে রং মাখানোর আনন্দই যেন আলাদা। পাড়াতুতো দেওর বউদিদের খুনসুটি মাখানো রং খেলা তো সর্বজনবিদিত। স্কুল কলেজ বন্ধ থাকে বলে আগের দিনই রংচং নিয়ে  ভূত সাজে ছাত্রছাত্রীরা। প্রচুর প্রেমের সূত্রপাতও হয় এই দিন।
তারও পরে রঙের পাশাপাশি দোলের অঙ্গ হয়ে ওঠে পঁচা ডিম, মোমের ফুচকা, মোবিল, এমনকী কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি অত্যন্ত বিপজ্জনক নানান রংও। যা হাজার চেষ্টা করেও এক-দু’দিনে ওঠানো তো দূরের কথা, এক সপ্তাহ পরে তোলাও প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। শুধু তা-ই নয়, ওই রং যে চামড়ার পক্ষে  খুবই ক্ষতিকারক, তা ব্যবহারকারীরাও জানেন। তবু ব্যবহার করেন। শোনা যায়,  ওই রঙের জন্য কারও কারও চোখও নাকি নষ্ট হয়ে গেছে।
শহরের বাইরের ছবিটা অতটা ক্ষতিকারক না হলেও বেশ কদর্য। কাছাকাছি ডোবা না থাকলে শুধুমাত্র দোলের জন্যই রাতারাতি ছোট ছোট ডোবার মতো গর্ত করে তাতে আগে থেকেই গোবর জল গুলে রাখা হয়। লোকজনকে কোলপাঁজা করে তুলে এনে সেখানে ফেলে নাকানি চোবানি খাওয়ানোর মজাই নাকি আলাদা। কোথাও আবার বালতি করে নোংরা জল লুকিয়ে লুকিয়ে এনে পেছন দিক থেকে আচমকা কারও মাথায় ঢেলে দেয়।
আর এই রং দেওয়ার অজুহাতে কিছু ছেলেপুলে কোনও কোনও মেয়ের সঙ্গে যে অশালীন ব্যবহার করে না, তাও নয়। আর তা নিয়ে দোলের দিন পাড়ায় পাড়ায় গণ্ডগোলও কম হয় না। সেই রেশ থেকে যায় বেশ কয়েক দিন।
তার ওপরে, এই দিনে বেশ কিছু উঠতি ছেলেমেয়েদের মধ্যে মদ খাওয়ার প্রতি একটা প্রবল প্রবণতা দেখা যায়। তাই প্রশাসনের তরফ থেকে বারবার আগাম সতর্কবার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়। রাস্তায় রাস্তায় টহল দেয় সাদা পোশাকের পুলিশ। ধরপাকড় চালায় একই বাইকে তিন-চার জন মিলে হুল্লোড় করতে করতে যাওয়া উৎশৃঙ্খল বাইক আরোহীদের। ফলে এক সময় যা ছিল নিখাদ আনন্দের, রং মাখানোর পরে মিষ্টিমুখ করানোর সামাজিক রীতি, আস্তে আস্তে তা উধাও হয়ে যায়।
দোল আসলে হিন্দু সভ্যতার প্রাচীন উৎসব। তাই নারদ পুরাণ, ভবিষ্য পূরাণ ও জৈমিনি মীমাংশা’তেও রঙের উৎসবের বিবরণ পাওয়া যায়।  তিনশো খ্রিস্টপূর্বাব্দের এক শিলালিপিতেও রাজা হর্ষবর্ধনের ‘হোলিকোৎসব’ পালনের উল্লেখ দেখতে পাই।
অনেকেই এই দোলের সঙ্গে ‘হোলি’কে গুলিয়ে ফেলেন। আসলে হোলি আর দোল কিন্তু এক নয়। সম্পূর্ণ আলাদা।
স্কন্দ পুরাণ থেকে জানা যায়, দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর ভাই হিরণ্যাকের মৃত্যু হয় বিষ্ণুর হাতে। তখন ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য শোকে মুহ্যমান হিরণ্যকশিপু কঠোর তপস্যায় বসেন। তাঁর সাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা তাঁকে বর দেন---  না জলে,  না স্থলে,  না ঘরে,  না বাইরে,  না রাতে, না দিনে, না আকাশে, না মাটিতে, না অস্ত্রে,  না শাস্ত্রে--- কোথাও, কোনও কিছুতেই তাঁর মৃত্যু হবে না।  শুধু তা-ই নয়, নাগ, অসুর, দানব, গন্ধর্ব, দেবতা, পশু, মানুষ, যক্ষ, রক্ষ, কিন্নর,  দিকপাল,  লোকপাল,  প্রজাপতি--- এক কথায় ব্রহ্মার যত সৃষ্টি আছে, তারা কেউই তাঁকে হত্যা করতে পারবে না।
এই বরে হিরণ্যকশিপু এতটাই ঔদ্ধত্য হয়ে উঠেছিলেন যে, ক্রমশ দেবতাদেরই তিনি অবজ্ঞা করতে শুরু করেন। বিশেষ করে বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন বিষ্ণুর। কারণ, এই বিষ্ণুর হাতেই বধ হয়েছিল তাঁর ভাই।
তাঁর ছেলে প্রহ্লাদ যেহেতু বেশ কিছু দিন নারদের হেফাজতে ছিল, তাই সে হয়ে উঠেছিল পরম বিষ্ণুভক্ত। সে এতটাই ভক্ত হয়ে উঠেছিল যে,  সে জন্য তার নামের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল ‘ভক্ত’ শব্দটা। তাই প্রহ্লাদ থেকে সে সবার কাছে হয়ে উঠেছিল--- ভক্ত প্রহ্লাদ।
তাঁর চরম শত্রু বিষ্ণুর  প্রতি ছেলের এই পরম ভক্তি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না হিরণ্যকশিপু। তাই সেই ভক্তি দূর করার জন্য  ছেলেকে তিনি নানা ভাবে বোঝাতে লাগলেন। লোভ দেখাতে লাগলেন। কিন্তু তাতেও কোনও ফল না হওয়ায় তাকে জব্দ করার জন্য তিনি নানা রকম শাস্তি দিতে লাগলেন। কিন্তু তাতেও ছেলের কোনও হেলদোল না দেখে তিনি শেষ পর্যন্ত কঠিন কঠোরতম পথই বেছে নিতে বাধ্য হলেন। স্থির করলেন তার মৃত্যুদণ্ড।
কখনও ক্রুব্ধ দৈত্যরাজ মশানে গিয়ে প্রহ্লাদের ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা করার হুকুম দিলেন। কখনও বদ্ধঘরে বিষধর  সাপ ছেড়ে দিতে বললেন।  কখনও পাগলা হাতির পায়ের সামনে তাকে ছুড়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন। কখনও আবার হাত-পা বেঁধে গলায় বিশাল বড় পাথরের চাঁই বেঁধে অতল সমুদ্রে ফেলে দিতে বললেন। আর প্রতিবারই একের পর এক নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসতে লাগল ভক্ত প্রহ্লাদ।
তখন একেবারে তিতিবিরক্ত হয়ে হিরণ্যকশিপু স্মরণাপন্ন হলেন তাঁর বোনের। তাঁর বোন ছিলেন হলিকা রাক্ষুসি। তিনি তপস্যা করে দেবতাদের কাছ থেকে বর পেয়েছিলেন, আগুন তাঁকে কখনও পোড়াতে পারবে না। তাই হিরণ্যকশিপু তাঁকে পরামর্শ দেন, তাঁর ছেলেকে নিয়ে জলন্ত আগুনে প্রবেশ করার জন্য। যাতে তাঁর ছেলে আগুনে পুড়ে খাক হয়ে যায়।
হিরণ্যকশিপুর নির্দেশে তাঁর লোকজনেরা প্রচুর কাঠকুঠো স্তূপীকৃত করে তাতে আগুন ধরিয়ে দিলেন। আগুন দাউদাউ করে জ্বলতেই দাদার কথা মতো ভক্ত প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে তিনি সেই আগুনের মধ্যে প্রবেশ করলেন।আগুনে ঢোকার সময় তাঁর স্মরণেই ছিল না,  দেবতারা তাঁকে বর দেওয়ার সময় একটা শর্তও চাপিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন,  তুমি যদি কখনও এটাকে অপব্যবহার করো, তা হলে এই বরের যাবতীয় গুণ নষ্ট হয়ে যাবে এবং  আগুন তোমাকে গ্রাস করবে।
যেহেতু একটা নিরাপরাধ নিষ্পাপ শিশুকে পুড়িয়ে মারার জন্য উনি আগুনে প্রবেশ করেছিলেন,  সেই অপরাধে  তাঁর সেই ‘বর' -এর গুণ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে যা হবার তা-ই হল।
হলিকা রাক্ষুসি আগুনের ভিতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে গেলেন। আর সেই আগুন থেকে হরিনাম করতে করতে একদম অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে এল একরত্তি বালক--- ভক্ত প্রহ্লাদ।
সেই থেকেই অশুভশক্তির বিরুদ্ধে শুভশক্তির জয়ের দিন হিসেবে হলিকাদহন পালন করা হয়। হলিকা রাক্ষুসির নামেই। পরে ধীরে ধীরে অপভ্রংশ হয়ে লোকের মুখে মুখে সেটাই হয়ে যায় হলিকা দহন থেকে শুধু--- ‘হোলি'। কেউ কেউ অবশ্য ‘হোরি’ও বলে।  সমস্ত ‘অপ’কে পুড়িয়ে শুদ্ধিকরণ করাই হল  এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্য। তাই দোলের আগের রাত্রে খড়কুটো জড়ো করে আগুন লাগানো হয়। এটাকে কোথাও বলা হয় চাঁচড়,  কোথাও নেড়া পোড়া। কিন্তু না, এখন আর কাউকেই বলতে শুনি না এর আর একটা কঠিন নাম--- ‘বহ্র্যুৎসব’।
যদিও এই দুই উৎসবের সঙ্গেই ওতপ্রোত ভাবে জড়িত এই নেড়া পোড়া বা চাঁচর পোড়ার অন্য আর একটা আধুনিক ব্যাখ্যাও রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, দোল বা হোলি যেহেতু ঋতুচক্রের শেষ উৎসব, তাই উৎসবের আগেই গাছপালা থেকে ঝরে পড়া ডালপাতা, জীর্ণ, ভাঙাচোরা, পুরনো জিনিসপত্র, যেখানে যা আছে, সব এক জায়গায় জড়ো করে পোড়ানোর উদ্দেশ্যই হল চারিদিক একেবারে সাফসুতরো করা। আবার নতুন ভাবে  জীবন শুরু করা।এই নতুন ভাবে জীবন শুরু করাই হল নেড়া পোড়ার আসল লক্ষ্য।
লক্ষ্য যাই হোক, আমরা কিন্তু এই দোলকে রঙের উৎসব হিসেবেই বেছে নিয়েছি। কিন্তু রং যাতে আমাদের কোনও ক্ষতি করতে না পারে, সে জন্য আবির তৈরির আদিম ঘরানাকেই ফিরিয়ে আনার তোড়জোড় চলছে বহু দিন ধরেই। ছোটখাটো বিভিন্ন সংস্থা হার্বাল আবির বানাতে শুরু করে দিয়েছে।  বিভিন্ন ফুলের পাঁপড়িকে বিশেষ পদ্ধতিতে গুঁড়ো করা হচ্ছে। তার পর তাতে নানান ফুলের নির্যাস মিশিয়ে একেবারে হান্ড্রেড পারসেন্ট নির্ভেজাল এবং নিরাপদ আবির বানানো হচ্ছে। সে জন্য তাদের উদ্যোগকে বাহবা দিতেই হয়।  কিন্তু কথা হচ্ছে, সেগুলো বানাতে গিয়ে এতটাই ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে যাচ্ছে যে, সেটা আর সাধারণ লোকের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকছে না। ফলে উদ্যোগ ভাল হলেও তা মুখ থুবড়ে পড়ছে।
তবু বলব, দিনের শেষে আমাদের মনে যতই কালিমা থাকুক, যতই কষ্ট থাকুক, বছরের অন্তত এই একটা দিন রঙের ছোঁয়া পেয়ে, সব দুঃক্ষকষ্টকে দূরে সরিয়ে আমরা কিন্তু রঙিন হয়ে উঠি। অন্তত রঙিন হয়ে ওঠার চেষ্টা করি।  এখানেই দোলের সার্থকতা। হোলির পরিপূর্ণতা। বসন্তের শ্রেষ্ঠ উৎসব।

সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২০


   অণুকবিতা
      
        অনুশ্রীতা বিশ্বাস,ঋভু চট্টোপাধ্যায়, 
      বিশ্বজিৎ হালদার, ডঃ রমলা মুখার্জী,
      রীতা রায়,সোমাধর ঘোষ, বদরুদ্দোজা        শেখু,পিয়ালী গোস্বামী, ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায়,
   আব্দুস সালাম,প্রতিমা ভট্টাচার্য্য মন্ডল,
              বর্ণালী দত্ত,অরিন্দম মাইতি

                        অণুগল্প

             ‌  রাণা চ্যাটার্জী, মহুয়া মিত্র, 
           আনন্দময়ী মুখোপাধ্যায়

কবিতা :ঋভু চট্টোপাধ্যায়


                       না  বলা অথবা  
                       ঋভু চট্টোপাধ্যায়

               এভাবে বুকের অগুন জ্বালাতে পারিস
              যেভাবে তুলি ক্যানভাস জুড়ে থাকে
              একটা গহিন বন্য নদীর ধারে
             যেভাবে হাজার স্বপ্ন ধরে রাখে।
             এভাবে কেউ পাগল হতে পারে
             যেভাবে মেঘ আকাশকে রাখে ফন্দি
             কাউকে ছুঁয়ে যাযাবর হতে পারি
          আমিও তো সেই উদাসীন স্রোতে বন্দি।

কবিতা: অনুশ্রীতা বিশ্বাস


             আলোহীন জানালার ধারে
                     অনুশ্রীতা বিশ্বাস

           আলোহীন  জানালার  ধারে
                      পথিকের  পায়ের  শব্দে,
          মনের  তীব্র  আবেগে দমিত
                     দহন হৃদয়সংকূলে -
                   শীতল বায়ুর স্পর্শে
          দমিত  আবেগে  স্পর্শ  এনেছে,
                  পথিকের  পথ চেয়ে
               আবারও  প্রদীপ জেলেছে।