বৃহস্পতিবার, ১৬ মে, ২০১৯


                                       বাৎসল্য
                                 পারমিতা ভট্টাচার্য্য
                                
কাজরী খুব গরীব। এক ছেলে, এক মেয়ে আর ঘরে পঙ্গু স্বামী কে নিয়ে তার ছোট্ট সংসার। আর আছে কমলা। নিজের মেয়ের মতই স্নেহ করে কাজরী কমলা কে। কমলাও খুব বাধ্য কাজরীর। সেও কাজরী কে খুব ভালোবাসে। যা বলে তাই শোনে। কমলা হলো আসলে কাজরীর পোষা গরু। গত তিন দিন হলো তার একটা ছোট্ট ফুটফুটে বাছুর হয়েছে। দেখতে হয়েছে ঠিক কমলার মত। কপালে তার একটা মস্ত বড় চাঁদ। তাই কাজরীর ছোট্ট ছেলেটা তার নাম রেখেছে - চাঁদা। বড্ড ভালোবাসে চাঁদা কে ওরা দুই ভাই বোন। অন্য দিকে কাজরীও খুব ভালোবাসে কমলা কে, কারণ ওর দুধ বেচেই মূলত সংসার চলে কাজরীর। শুধু কি দুধ? ঘি, ঘুঁটে সব কিছুই। তাই সংসার খরচের বাইরে গিয়েও কাজরী যত্ন করে কমলা কে। চানা, খোল, ভুসি সবই খাওয়ায় কমলা কে। একটু বেশি দুধের আশায় কোথায় হালি ঘাস, কাঁটানটে, কুকসিনে পাতা প্রভৃতিও কমলার জন্য জোগাড় করতো কাজরী। এই ক'দিন কমলার দুধ কী করে কমে গেল সেটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পাচ্ছিল না কাজরী। এতো খাটে গরু টার পিছনে,  সবই কি তাহলে পন্ডশ্রম? এক দিন কাজরী দেখে এই সবই তার গুণধর ছেলের কাজ। দিন কুড়ি হয়ে যেতেই কাজরী কমলার বাছুর টাকে রাতের দিকে বেঁধে রাখতো। কারণ বাছুরে দুধ খেয়ে নিলে আর বেশি দুধ পাওয়া যাবে না। অন্য দিকে কমলার ছোট বাছুরের কষ্ট কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারতো না কাজরীর ছোট্ট ছেলেটা।  সে মা কে বারবার বলতো, চাঁদা কে ছেড়ে দিতে। ছোট ছেলের কথায় কে আর কান দেয়। তাই সে ভোরের বেলা উঠে ছোট্ট বাছুরটা কে চুপিচুপি মায়ের চোখের আড়াল করে চোরের মত দুধ খাইয়ে আসতো। চুরি করে খেতেও যেমন মজা তেমন চুরি করে খাইয়েও তেমন আনন্দ, তা ওই টুকুনি ছোট্ট হৃদয় অনুধাবন করতে পেরেছিল। মায়ের কাছে ধরা পড়তেই কাজরী তার ছোট্ট ছেলে কে কান মোলা দেয়। ছেলেটির মধ্যে একটুও অনুশোচনা আঁচ পেল না কাজরী। বরং দেখল একটি অবলা প্রাণীর জন্য তার ছোট্ট ছেলেটির গভীর আকুতি। মা ও সন্তানের যে গভীর মেলবন্ধন তা শুধু মাত্র মনুষ্য জগতের জন্য যে সীমাবদ্ধ তা নয়, সমগ্র প্রাণী জগতই এর আওতাভুক্ত। এটাই কাজরীর ছোট্ট ছেলেটি অনুধাবন করতে শিখিয়েছিল তাকে। আসলে এই চৌর্যবৃত্তি তে কারো কোনও ক্ষতি ছিল না। এটা একটা ছোট্ট হৃদয় কে মহান করেছিল মাত্র। দিন আনা - দিন খাওয়া সংসারে নিজে না খেয়ে অপরের কথা ভাবা, বিশেষ করে মায়ের কাছে বকুনি খেয়েও এতো টুকুনিও মন খারাপ না করে আনন্দে মন ভরে ওঠার মাঝেও একটা অসম্ভব পরিতৃপ্তি আছে, সেটাই বাচ্চা ছেলেটি আত্মস্থ করতে পেরেছিল। 

কোন মন্তব্য নেই: