বুধবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৯


                                 ★ অনুপ্রবন্ধ 
                         কাঁটা তারে ঝুলে থাকা শব
                                        বৈদুর্য সরকার


দেশের সত্তরোর্ধ্ব স্বাধীনতার হাল হয়েছে পেনসন নাথাকা হাঁপানি ও বাতের ব্যাথায় ভোগা খিটখিটে বুড়ো-স্বরাজ বসুর মতো । যার স্ত্রী ভারতী, ছেঁড়া শাড়িতেসাক্ষাৎ ভারতমাতা । ছেলেরা কেউ বাইরে চাকরিকরছে, নকশাল টাইমে একজন মরেছে, কেউ পাড়ারদাদা হয়েছে, কলেজে পড়ার সময় বাড়ি ছেড়েপালানো বড় মেয়ে ডিভোর্স করে বাপের বাড়ি ফিরেএসেছে, আরেক মেয়ে প্রতিবন্ধী – বাইরে বেরোতেপারে না । মানে, যাকে বলে – একদম সুখের সংসার। তবে ভারতমাতার এই সংসারে বাজারে কিছু ধারজমে যাওয়া সত্ত্বেও কোনও রোববার দুপুরে খাসিরমাংসের খুসবু বেরোয়, পুজোয় সবার নতুন জামা হয়,ছাদ দিয়ে বর্ষায় কয়েক ফোঁটা করে জল পড়লেওইলিশ ভাজার গন্ধও পাওয়া যায় এক আধদিন। শীতেরসন্ধেয় ছাদের টবে ফোঁটা বেলফুলের গন্ধ হাওয়ায়ভাসে বেশ । ভারতীর বন্ধু পাশের পাড়ার হাসিনাঈদের দিন সিমুই দিয়ে যায় ।  নাতি নাতনিরাক্রিসমাসের ছুটিতে এসে টুপি আর কেক নিয়েহুটোপাটি করে । সব মিলিয়ে বেশ কেটে যাচ্ছে দিন ।            
                       ★
চালু ধারণা, ভারতে মানবসভ্যতার ইতিহাস ( সিন্ধুসভ্যতাকে প্রামাণ্য ধরলে ) পাঁচ হাজার বছর ।  এতবছরেও ভারতবাসী সঠিক বুঝে উঠতে পারলো না –তারা আর্য নাকি অনার্য অথবা মঙ্গোল কিংবাককেশীয় । ভারতে এত বছরে এতরকম আক্রমণ এতরাজার রাজত্ব এসেছে – আসল পরিচয়টাই মুছে গেছে। এত লোকের পূর্বপুরুষ কে যে কোথা থেকে এসেছিলকোনও হদিস নেই ! তাই সাড়ে বত্রিশ ভাজার মতোশুধু টিকে আছে একটাই পরিচয় – ইণ্ডিয়ান । যদিওজানা গেল – আজও সবার নাম নথিভুক্ত নয় ।
                       ★
মাধ্যমিক পরীক্ষায় ম্যাপ পয়েন্টিংয়ে যে ম্যাপ দেওয়াহতো – তার অনেকটাই কল্পিত । লজ্জায় মাথা কাটাগেছে – একদিকের অংশ পাকিস্তান অধিকৃত আজাদকাশ্মীর, আরেকদিকে অক্ষয় চীন । সেখানে এখনপ্রতিবেশী দেশের সেনাবাহিনী মোচ্ছব করছে ।অরুণাচল সীমান্তও অরক্ষিত প্রায় – যে কোনও সময়েক্ষমতাসম্পন্ন চীনের হানাদাররা ধেয়ে আসতে পারে ।তিব্বত নিয়েও দীর্ঘদিনের মন কষাকষি । কাশ্মীরেরঅবস্থা প্যালেস্তাইনের মতো – গুলি থামে না । জম্মুই সম্ভবত ম্যাপের ওপর দিকের সেই প্রান্ত যেখানেনির্বিঘ্নে স্বাধীন ভারতের তেরঙা উড়বে পতপত করে ।যদিও এককালে এখান থেকে যে সব পণ্ডিতরা হারিয়েগেছিল, তাদের কোনও খোঁজ মেলেনি  আজও ।
                       ★
স্বাধীনতার আন্দোলনের সময় বিভিন্ন সংগঠনবিভিন্নরকম পতাকা ব্যবহার করলেও ১৯৪৭-র ২২জুলাই থেকে অন্ধ্রের পিঙ্গালি ভেঙ্কইয়ার ডিসাইন করাত্রিবর্ণরঞ্জিত জাতীয় পতাকা ব্যবহৃত হচ্ছে । স্বাধীনতাকি প্রকৃত অর্থেই ত্রিবর্ণরঞ্জিত নাকি স্বাধীনতার রংসশস্ত্র বিপ্লবীদের রক্তের মতো লাল অথবা বর্ডারপেরোনো মানুষর মতো পাংশু কিংবা কারাগারেরঅন্ধকারের মতো কালো – সে উত্তর জানতে পারিনিএখনও । লাল কেল্লায় স্বাধীনতা দিবসের উদযাপনেরসময় জঙ্গী হামলার খবর যে ভেসে আসবে না – তাইবা কে বলতে পারে ! কেউ কি বলতে পারে সার্বভৌমরাষ্ট্রের ধারণা নস্যাৎ করে – আঞ্চলিক ম্যাপগুলোক্রমাগত বদলে চলেছে কাদের উস্কানিতে !সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বেশ গালভরা একটা কথাহলেও – তা থেকে গেছে বিজ্ঞাপনী প্রচারের মতো ।যেগুলো নিয়মমাফিক প্রচারিত হয় – কেউ বিশেষকান দেয় না । ভারতে সেক্যুলার গপ্পো নিয়ে রাজনীতিকরে একদল, আরেকদল তার উল্টো কথা বলে লোকখ্যাপায় ।
                       ★
ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ার আগে ভারত কখনও সমষ্টি হিসেবেথাকেনি, বেঁচে ছিল অনৈক্য এবং আঞ্চলিকতায় ।মধ্যযুগে মোগল সুলতানরা, খিলজি-লোধি কেউইপারেনি গোটা ভারত একযোগে শাসন করতে । তারআগে মৌর্য গুপ্ত কুষান যুগেও হয়নি সের’মসম্প্রসারণ । স্বাধীনতা এসেছিল যেহেতু দেশভাগেরপরিণতির মাধ্যমে এবং তা মূলত ধর্মের ওপর ভিত্তিকরে, তাই ধর্মের অনুশাসনগুলো নিয়ে আজকেরবিজ্ঞান প্রযুক্তির এতরকম অগ্রগতির পরেও দেশেরঅধিকাংশ মানুষ ভীষণ ভাবিত । ইতিহাস অনুযায়ীপাঞ্জাব ও বাংলার কিছু অংশ স্বাধীনতার সময়অদলবদল হয়েছিল। হায়দ্রাবাদের নিজাম পাকিস্তানেযেতে চেয়েছিল কিন্তু ওখানকার বেশীরভাগ মানুষছিল হিন্দু। আবার কাশ্মীরে উল্টো ব্যাপার । রাজাহিন্দু কিন্তু প্রজারা মুসলমান । পুরোপুরি কনফিউজিংঅবস্থায় র‍্যাডক্লিফের আগোছালো ম্যাপ অনুযায়ীতাড়াহুড়ো করে দেশভাগ করে কংগ্রেস ও মুসলিমলীগের নেতারা গদিতে বসে পড়ে । যার জের এখনওচলছে – হয়তো যতদিন উপমহাদেশে সভ্যতা থাকবে,ততদিন ভাঙন ধরা এককালের যৌথ পরিবারের মতোখিটমিটি লেগেই থাকবে।
                       ★
পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার প্রশ্নে ভারতসক্রিয় থেকেছিল – রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক যেকারণেই হোক । ফলে এই দেশে আশ্রয় দিতে হয়েছেঘর হারানো কোটি মানুষকে । ১৯৭১ থেকে আসামানুষের স্রোত এখনও অব্যাহত – ওদিক থেকেএদিকে । শোনা যায় একই কায়দায় বাংলাদেশ থেকেকলকাতা হয়ে জঙ্গিদেরও অনুপ্রবেশ ঘটছে । যদিওনাকি তারা সেফ করিডর হিসেবে ব্যবহার করারসুবিধের জন্যই কলকাতায় বিশেষ হাঙ্গামা করে না । 
এই অনুপ্রবেশকে আটকাতে – তৈরি হওয়া অসমেরখসড়া জাতীয় নাগরিকপঞ্জি নিয়ে বিতর্ক চলছে,অরুণাচল নিয়েও একই সংকট । ঘরহারাদের মাথাগোঁজার ঠাই যেমন একটা সেন্টিমেন্ট, ভূমিপুত্রদেরজীবন জীবিকা সংক্রান্ত সমস্যাও তেমনই গুরুত্বপূর্ণ ।তাই তর্কের কোনও শেষ হয় না । বৃহত্তম গণতন্ত্রেসম্ভবত ভোটারের সংখ্যাটা গুরুত্বপূর্ণ বলে – কয়েককোটি মানুষের সঠিক পরিচয় জানা গেল না আজও।এটাও জানা গেল না – আনুমানিক আরও কত বছরসংরক্ষণ চালু থাকলে অনগ্রসর মানুষেরা দেশেরমুলস্রোতে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব ।

কোন মন্তব্য নেই: