শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৯



           
              মহারাজা তোমারে সেলাম

                                     সোহম ঘোষ


২১, রজনী সেন রোডের বাড়ির সামনে যখন লালমোহন বাবুর মাদ্রাজী সবুজ আ্যাম্বাসাডারটা দাঁড়াল ঘড়িতে তখন নটা পাঁচ। ফেলুদা সেই কোন সকালে উঠে ব্যায়াম করা, দাড়ি কাটা, স্নান সারা সব করে ওর আই-পডটাতে কি করছে। সবুজ খেরোর খাতা ছেড়ে এখন সব কিছু ওটাতেই তুলে রাখে। দু-একবার উঁকি মেরে দেখতে গেলাম তাতে ফেলুদা গাট্টা মারবে বলে শাসানি দিল। আমি সোফায় আধশোয়া হয়ে 'চাঁদের পাহাড়' পড়ছিলাম। ফেলুদা আড়চোখে দেখে নিয়ে বলল, "প্রচ্ছদটা কার আঁকা বলতো?"

"কার?"

আর কিছু না বলেই আই-পডে মন দিল ফেলুদা।এমন সময় লালমোহনবাবু ঢুকলেন।

ফেলুদা চোখ না উঠিয়ে প্রশ্ন করল,"আপনার সুডোকুর সমাধান পেলেন?"

লালমোহনবাবু খানিকটা অবাক হয়ে বললেন,"না, মানে ইয়ে আপনি জানলেন কি করে মশাই?"

"আপনার ডান পকেট থেকে আজকের কাগজটি উঁকি মারছে। আর বাঁহাতের তালুতে পেন দিয়ে লেখা সংখ্যাগুলোও বেশ চোখে পড়ছে। দাড়িয়ে রইলেন কেন, বসুন।"

লালমোহনবাবু বললেন, "হেঁ হেঁ। আর বলবেন না মশাই। সুডোকু নিয়ে আমি যাকে বলে ওভারহোয়েলম্যড। সুমাত্রায় সুডোকু বলে আমার শেষ গল্পে প্রখর রুদ্র সুমাত্রায় যায় সুডোকুর উৎস সন্ধানে। সুনামি ঢেউএর মাথায় চড়ে ভায়া ভারত মহাসাগর।"

"এসব লিখেছেন নাকি?"

"হ্যাঁ। ৩০০০০ কপি ছাপতে দিয়ে এলাম। পয়লা বৈশাখ বেরোবে। আপনি যখন কাল বললেন মানিকবাবু ডেকেছে। আমি ভাবলাম যাই, ওনাকেই নয় বলি বইএর উদ্বোধনে। ব্যস, সেলিং লাইক হট কচুরীস। কিন্তু কিছু ভুল হয়ে গেল নাকি মশাই!"

"সে তো হয়েছেই। সেসব পরে বলে দেব। তোপসে পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেরতে হবে। তুই চট করে তৈরি হয়ে নে।"

লালমোহনবাবু সোফায় বসে আমায় জিজ্ঞেস করলেন, "কি তপেশ ভাই। কেমন কাটছে?"

"ভাল।আপনি ব্রেকফাষ্ট করেননি তো?"

"সে চিন্তা নেই ভাইটি। যাবার পথে আজ খাব। হট কচুরীস।"

সবাই নিচে নামলাম যখন ঘড়িতে নটা কুড়ি। হরিপদবাবু আনন্দবাজারটা ভাঁজ করে গাড়িতে স্টার্ট দিলেন। ফেলুদা সামনে বসে আই প্যাডের হেডফোন কানে গুঁজে। গাড়ি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জ্জী রোডে উঠল।

লালমোহনবাবু ফিসফিস করে বললেন,"হাইলি ট্যালেন্টেড লোক মানিকবাবু। ৫০ টার বেশি ন্যাশানাল আ্যাওয়ার্ড।"

"৩২ টা।"

"৫০ নয়?" বিড়বিড় করে মিইয়ে গেলেন।

"অবশ্য ভারতরত্ন তো একাই একশো।"

"বলছ? তবে!"

"ফেলুদা বলছিল ওকে নাকি তিনবার দাবাতে হারিয়ে দিয়েছিলেন"

"তিনবার নয়। দুবার" সামনের সিট থেকে বলে উঠল ফেলুদা "ওয়েস্টার্ন মিউজিকের উপরও অগাধ পান্ডিত্য।"

টালিগঞ্জ থানার সামনে দিয়ে গাড়িটা যাচ্ছিল। ফেলুদা কাউকে একটা হাত নাড়াল।

রাসবিহারী ক্রসিংএ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। ফেলুদা একটা চারমিনার ধরিয়ে রিং ছুড়তে লাগল। বিশপ লেফ্রয় রোডে গাড়িটা ঢুকল। ফেলুদা বলল,"তোপসে জানিস এই রাস্তাটা এক আইরিশ সাহেব জর্জ আলফ্রেড লেফ্রয়ের নামে। লাহোরের বিশপ ছিলেন তিনি। ওর লেখা একটা বই আছে। দ্য লেদার ওয়ার্কারস অব দরিয়াগঞ্জ। সিধুজ্যাঠার কাছ থেকে এনে পড়েছিলাম। ১৮৮৪ তে লেখা। পড়ে দেখতে পারিস।"

বলতে বলতে গাড়ি ১/১ র সামনে দাড়াল। লি রোড ক্রসিং। উপরে শোবার ঘরে মানিকবাবু।

ঘরে এক ভদ্রলোকও আছেন। টাক মাথা সাদা দাড়ি।

ফেলুদা ঘরে ঢুকে,"মানিকবাবু নমস্কার।"

তারপর ভদ্রলোককেও একইভাবে নমস্কার জানালেন। " তারিণীখুড়ো নন। সাদা দাড়ি। ধূলোতে ধূসর মানে দূর থেকে আসছেন। আপনি প্রোফেসর না? প্রোফেসর শঙ্কু?"

"হ্যাঁ।"

মানিকবাবু প্রোফেসর শঙ্কুকে বললেন," আলাপ করিয়ে দিই। প্রদোষ সি. মিটার। ডিটেকটিভ। লালমোহন গাঙ্গুলি, লেখক। তপেশরঞ্জন মিত্র, প্রদোষের খুড়তুতো ভাই।"

"আচ্ছা আজ উঠি মি. রায়।" 

"তারপর ফেলু কেমন আছ?"

"আপনি বলুন আগে কেমন আছেন?"

"আমি ভালই আছি। তবে বয়স হচ্ছে। শুনলাম এই পাশের লি রোডটার নাম সত্যজিৎ রায় ধরণী হল। একটু খোঁজ নিও তো এরকম কেনই বা হল? এর আগে কোথাও হয়েছে এরকম? আচ্ছা তোমার হাতে কোনও কেস নেই তো?"

"না না। কাফকার একটা অনুবাদ করছি। কিন্তু সেটা এমন কিছু তাড়াহুড়ো নেই। আমি ফাঁকাই আছি।" 

লালমোহনবাবু অনেকক্ষণ উসখুশ করছিলেন।

" লালমোহনবাবু কি কিছু বলবেন?"

"আচ্ছা, বিজয়া দেবী কি আপনার ফার্স্ট কাজিন ছিল?"

কটমট করে তাকাল ফেলুদা। রাশভারী সত্যজিৎ বাবু গোমড়া হতে গিয়েও হেসে ফেললেন।

"আমার থেকে একবছরের বড় ছিল বিজয়া। প্যারিসে পড়ত। ৮ বছরের প্রেম আমাদের। ফেলু, বোধহয় জানো চিত্তরঞ্জন দাস আমার মামাশ্বশুর হন। বাড়িতে মানছিল না। আমরা ৪৯এর অক্টোবরে রেজস্ট্রি করি বাড়ির অমতে। পৃথ্বীরাজ কাপুর আসেন আশীর্বাদে। মার্চে বাড়িতে মেনে নেয়। নশুবাবু খুব বোঝায় মাকে। আমিও আবার ওকে বিয়ে করলাম। বাঙালি মতে।"

ফেলুদা বলল,"ET দেখে আপনার মনে হয়নি এটা আপনার সিনেমা। বঙ্কুবাবুর বন্ধুতে তো আপনি এটাই করতে চান।"

"হাইলি সাসপিশাস।" লালমোহনবাবুর গলা।

"আমি ওসব ভুলে গেছি ফেলু। একপয়সাও দেয়নি কেউ। ছাড়ো। সব ধরতে নেই।"

আমিও প্রশ্ন করলাম,"কাঞ্চনজঙ্ঘাই কি প্রথম রঙিন বাংলা ছবি?"

"হুম। ১৯৬২ তে। তার আগের বছর কবি সুভাষ আর আমি আবার সন্দেশ চালু করলাম।"

এমন সময় হরিপদবাবু কচুরী নিয়ে উপরে এলেন। সদ্য ভাজিয়ে আনা। আমরাও উঠে পরলাম।

"ব্যাপারটা দেখো ফেলু।"মনে করিয়ে দিলেন মানিকবাবু।

হেসে ঘাড় নাড়িয়ে নেমে এল ফেলুদা। পিছুপিছু আমরাও।

লালমোহনবাবুর পিঠে হাত দিয়ে ফেলুদা বললেন,"থ্যাঙ্কস লালমোহনবাবু। আমি একদম ভুলে গেছিলাম কিছু নিয়ে আসতে। আপনি আর হরিপদবাবু বাঁচালেন আমায়।"

"আরে মশাই। আপনাকে তো আগেই বলেছি এ বি সি ডি। আর আমি হলাম ই এফ।"

"সেটা আবার কি?"

"ইস্পেশ্যাল ফ্রেন্ড।আপনার"

বাড়ির পথে রওনা হলাম আমরা।


       *-------*--------*--------*-------*

কোন মন্তব্য নেই: