সাহিত্য কালচার
প্রথম বর্ষ, আত্মপ্রকাশ সংখ্যা
সূচিপত্র
কবিতা:-
তুষারকান্তি রায়,জয়ীতা চ্যাটার্জী,মুহম্মদ আবু বকর, রাণা চ্যাটার্জী, সুস্মিতা অধিকারী,জয়দীপ রায়, আঁখি সরকার(রাই), পিঙ্কি দে, তাজিমুল রহমান,কৌশিক দাস,সৌরভ বর্ধন,অদিতি চক্রবর্তী, অনুপম চক্রবর্ত্তী,সুজান মিঠি, অভিজিৎ দাসকর্মকার,তৈমুন খান,অভিজিৎ দত্ত,শম্ভুনাথ মন্ডল, জ্যোতির্ময় মুখার্জি, শান্তনু গঙ্গারিভি, সুনীল মাইতি,সৈয়দ মহঃসাবির আলি, অর্পিতা ভট্টাচার্য,অঞ্জলি দে নন্দি।
প্রবন্ধ:-
সায়ন দাস,
ছড়া:-
শুভম রায়, এম.ডি.সবুজ, মৌসুমী ভৌমিক, লিপি ঘোষ হালদার
গল্প:-
সৌমেন সরকার, সঞ্জয় ঘোষ,শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী,
গদ্য:-
শাশ্বতী সরকার
_____★_____★______★_____
কথা
তুষারকান্তি রায়
এতগুলো কথোপকথনের পরেও
তোমাদের কোন কথাই হলো না আশ্চর্য !
সে কি কথা !
তোমার দু'চোখে যে
এখন ও কবিতার ধুলোবালি !
আচ্ছা ! পাখিদের মতো
নীড়ের সন্ধানে পথহাঁটা
তোমার পঙক্তিগুলি কী জানে?
জল আর সাঁতারের কম্বিনেশন,
কিভাবে নিভৃত হয়ে ওঠে
তোমার অতিক্রম ;
নাম না জানা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে
একটি পুরুলিয়াগামী ট্রেন চলে গেলে
মধ্যরাতের আকাশে
লুব্ধক কতটা সঙ্কেতময় !
হাওয়ায় দেখি তার
দু' একটা প্রতিবর্ণ; পালক . . .
কতকাল তোমাকে দেখি না।
বিষয়:-অনুকবিতা
-------------------------------
সম্পর্ক
জয়ীতা চ্যাটার্জী
কোথাও কোন মন নেই, কেবলই আসক্তি।
প্রেমিকের কবিতা জুড়ে শরীরী ব্যকরণ,পুরুষ- নারী-লিঙ্গ-বিভক্তি।আত্মিক অনুভূতির অভাবে
আজ পৃষ্ঠাও কাঁদে উপুড় হয়ে শুয়ে, কাঁদে শব্দ একটা একটা কবিতায় সত্যের জন্যে নুয়ে।
নিঃসঙ্গতার মন খারাপ
কোথাও কোন মন নেই, কেবলই আসক্তি।
প্রেমিকের কবিতা জুড়ে শরীরী ব্যকরণ,পুরুষ- নারী-লিঙ্গ-বিভক্তি।আত্মিক অনুভূতির অভাবে
আজ পৃষ্ঠাও কাঁদে উপুড় হয়ে শুয়ে, কাঁদে শব্দ একটা একটা কবিতায় সত্যের জন্যে নুয়ে।
নিঃসঙ্গতার মন খারাপ
মাহমুদ আবু বকর
কার্তিকের মাঠ
সদ্য ফেলা ধানের বীজের পাশে
গৃহস্থের হাঁস অার দূরদেশী বক।
তবু মন খারাপ;
চারিদিকে নিঃসঙ্গতার মন ভাল না থাকা।
হারান-ছাগলের খোঁজে বশিরের বউ
অরবে-সরবে অাসে মাঠের দিকে,
অার, দূরে এক কৃশকায় কৃষক ক্ষেতে নিড়ানি দেয়,
হুরুঙ্গা ফুলের বুকে কয়েকটা মৌমাছি
দৃশ্যের অাগাপাছতলায় শুধু এইটুকু।
তবু মন খারাপ;
অার কেউ থাকার কথা ছিল_
স্তনের উষ্ণতা নিয়ে।
বারুদ গন্ধ বাতাসে
রানা চ্যাটার্জী
কফিন ছুঁয়ে স্বজনহারা,চোখের কোনে জল
অতর্কিতে হামলা গুলি ,নপুংসকের দল ।
আজকে হঠাৎ পুলওয়ামা,কালকে ছিল উরি
ছকেই পতন প্রতিবেশী,তোমায় ঘেন্না করি।
সইব কত্ত,দুঃখ এত্ত,বীর সেনানী শহীদ প্রাণ,
আদেশ করো রাষ্ট্রনেতা,নিকেশ হোক শয়তান।
মাতছি সব দেশপ্রেমে,উত্তাল স্রোত স্ট্যাটাসে,
বীর জওয়ানে ভরসা আছে ,বারুদ গন্ধ বাতাসে!
কফিন ছুঁয়ে স্বজনহারা,চোখের কোনে জল
অতর্কিতে হামলা গুলি ,নপুংসকের দল ।
আজকে হঠাৎ পুলওয়ামা,কালকে ছিল উরি
ছকেই পতন প্রতিবেশী,তোমায় ঘেন্না করি।
সইব কত্ত,দুঃখ এত্ত,বীর সেনানী শহীদ প্রাণ,
আদেশ করো রাষ্ট্রনেতা,নিকেশ হোক শয়তান।
মাতছি সব দেশপ্রেমে,উত্তাল স্রোত স্ট্যাটাসে,
বীর জওয়ানে ভরসা আছে ,বারুদ গন্ধ বাতাসে!
উড়ন্ত ফড়িংয়ের দিকে তাকিয়ে
সুস্মিতা অধিকারী
নিজেকে দেখি।
উড়তে উড়তে উড়ে যায়
বৃষ্টি নামবে বলেই;
আকাশ থমথমে
একটু ভারহীন।
যত নেমে আসে
গর্জে ওঠে মৃত্যু। অথচ!
না চাইলেও চলে যেতে হয় ব্যাঙের ভেতর।
শ্রাবনের ভগ্নাংশ
নিজেকে দেখি।
উড়তে উড়তে উড়ে যায়
বৃষ্টি নামবে বলেই;
আকাশ থমথমে
একটু ভারহীন।
যত নেমে আসে
গর্জে ওঠে মৃত্যু। অথচ!
না চাইলেও চলে যেতে হয় ব্যাঙের ভেতর।
শ্রাবনের ভগ্নাংশ
জয়দীপ রায়
চিলেকোঠা জুড়ে মেঘলা ঘ্রাণ
তোর চোখে তখন ঘোর শ্রাবণ
তবে জানলার কাঁচ বেয়ে নেমে আসা
বৃষ্টি দেখতে চায়নি
আমি তো ভাগ চেয়েছিলাম
হাতে গোঁজা ভিজে রুমালটার
ভগ্নাংশের একের তৃতীয়াংশ কষ্টের।
তুমি আসবে
আঁখি সরকার রাই
যখন স্নায়ুরজ্জু জুড়ে বাতাবি দহন
কঠিন হবার ঘাসুরে মমতাদিন
বাহান্ন জুড়ে চলছিল কিশোরী বিকেলের ঋজু
গেঁথে দিও দক্ষিণ স্বরে।
অসময়ে স্বস্তি;
তাই চুপ করে থাকার উপোস
করেছিলাম নুভে যাওয়া মিছিল ঘুরে
তুমি আসবে, চেরা বিকেলের চিলে....
ওরা শহীদ
পিঙ্কি দে
ওরা থাকে অতন্দ্র প্রহরায়
আমরা থাকি ঘুমে,
ওরা বীরের মত লড়াই করে
মরণকে ন্যায় চুমে.
দেশের পতাকা জড়িয়ে ওরা
পায় শেষ বিদায়,
ওদের রক্ত শতশত বীরের
জন্ম দিয়ে যায়.
বৃক্ষ ঘাতক
তাজিমুর রহমান
এসো দূরত্ব কমাই। হেঁটে যাই পড়শি পথে
ভেতরে ডানা মেলুক সমুদ্রপুর
বৃক্ষঘাতক শুধু চিনে নিক
কাকে বলে অমরত্ব !
কৌশিক দাস
ছাদের কার্নিশে যে আগাছা জন্ম নিয়েছিল
গন্ধহীন ফুলে ভরিয়ে দিয়েছে বাড়ির বারান্দা
নিছকই রাত্রি জাগা ভারী জোস্নায়,আলোকবর্ষ
সপ্তষী মন্ডল আজও আমাকে টানে।
মৃতুবাস
অদিতি চক্রবর্তী
প্রয়াত হয়েছিলো সকাল টা..
পটভূমি সেই রাত্রি..
মৃত্যুর বাড়িটা সেজে উঠেছিলো কাঠগোলাপের পাপরিতে।।
পারিজাতেরা জল পেয়েও অন্তর্হত..
উলঙ্গ ছাই হয়ে পরে থাকতে দেখে..
লজ্জায় সেই নগ্ন শব দের কে দেখে হাসে।।
বিষচাক
সৌরভ বর্ধন
বালিশের এক কোণায় এসে শুই, সন্তর্পণে
ভাবি খাদ হবো, ঝাঁপিয়ে পড়ব নদীর গায়ে
আঁধার করে এলে শরীর থুয়ে উঠে যাবে ঘুম
অসম্ভব কোনো প্রেম ছেঁকে ধরবে বিষচাক
মাথার ভেতর টিনের স্তর বাজবে বাজবে
বাজছে বাজছে
বাজুক বাজুক
বাজতে দাও
দাও না!
আকন্ঠ স্মৃতি ধ'রে আছে এই শরীর। থাকতে দাও
জমানো আগুন
অনুপম চক্রবর্তী
জমানো আগুন ফুরিয়ে এলে
ছায়ারা দীর্ঘ হয় -
জলের দাগে লেখা হয় মনখারাপ
উদ্দ্যেশ্যের ভাঙা প্রাচীরে ।
অবহেলার টুকরো শেষে
যেটুকু শুন্যতা থাকে -
তার শিকড়েও জমে থাকে ,
এক পৃথিবী অন্ধকার ।
মেঘ- পেয়ালা
সুজাতা মিশ্র (সুজান মিঠি)
নষ্ট আগুন ধিকধিকিয়ে কোঠর পোড়ায় ঘা
বাঁশবাগানের জোনাক গুঁড়ি চাঁদ মাখানি গা।
গরম ধোঁয়ার মেঘ-পেয়ালা ঠান্ডা লড়াই বন্য,
উষ্ণ আগুন বাদাম-নেশায় রং ভরেছে অন্য।
ভালবাসি বললে মন ভাঙে
অভিজিৎ দাস কর্মকার
ভালবাসিঃআমি
বর্ণ↓ শরীর (নশ্বর)
আগন্তুক >ব্যাসার্ধ গড়ি
প্রতিসৃত নদীতীর| রজস্বলা মন (?)
ইচ্ছের ডানা= পরজন্মের ভ্রূনশাবক
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
ভালবাসিঃআমি
বর্ণ↓ শরীর (নশ্বর)
আগন্তুক >ব্যাসার্ধ গড়ি
প্রতিসৃত নদীতীর| রজস্বলা মন (?)
ইচ্ছের ডানা= পরজন্মের ভ্রূনশাবক
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
উৎস
তৈমুর খান
পরমায়ু খুঁজে পাই রোজ এই সন্ধ্যায়
তোমার আলোর কাছে এসে
অনেক তপস্যার দিনে আমিও সফল
অনন্ত ৠষির মতো রোজ উঠি হেসে।
তৈমুর খান
পরমায়ু খুঁজে পাই রোজ এই সন্ধ্যায়
তোমার আলোর কাছে এসে
অনেক তপস্যার দিনে আমিও সফল
অনন্ত ৠষির মতো রোজ উঠি হেসে।
মনের খোঁজে
অভিজিৎ দত্ত
সভ্যতার এই রশ্মিচ্ছটায়
ভালোবাসারা যাচ্ছে উড়ে
মনের কথা ঝলসে গেলো
মনটাই যে যাচ্ছে মরে।
ক্ষয়-ক্ষতি
শাম্ভুনাথ মণ্ডল
লাভের গুড় পিঁপড়েয় খেলে
বাজ পড়ে মাথায় -
রোদে পোড়ে-জলে ভেজে পথিক
কাজ হয় না ছাতায়।
অভিজিৎ দত্ত
সভ্যতার এই রশ্মিচ্ছটায়
ভালোবাসারা যাচ্ছে উড়ে
মনের কথা ঝলসে গেলো
মনটাই যে যাচ্ছে মরে।
ক্ষয়-ক্ষতি
শাম্ভুনাথ মণ্ডল
লাভের গুড় পিঁপড়েয় খেলে
বাজ পড়ে মাথায় -
রোদে পোড়ে-জলে ভেজে পথিক
কাজ হয় না ছাতায়।
লেখামি
জ্যোতির্ময় মুখার্জী
আমার লেখা ? না, লেখার আমি ?
দ্বন্দ্বটা বেশ প্রাচীন
উত্তরটাও অজানা নয়
তবু বারবার হাঁটু মুড়ে বসি তার সামনে
ও আমাকে আয়না দেখায়
আমি ওকে
[প্রাইম-টাইম]
শান্তুনু গঙ্গারিডি
বিপণ্যতার প্রাইম-টাইমে ঈশ্বরের হাতে গড়া রুটি
পরিমাণ মতো ক্যাপসিকামাতুর টমটম টমাটর।
বিলায়েতি মাটির জানেমন জান-বাহন
দলঝুট পাতাবাহারের বাহারি ওয়েব-জিন্
কোলাজিত পাৎলুনের অনন্ত বাহার
মুখরোচক টোটোরিক্সার ফটোফিনিক্স ভার্টিব্রা।
মিশ্রণ তৈরি হতে হতে অনায়াসে ধরা দেয় শ্রেণীকক্ষের কবন্ধ প্রবণতা।
জ্যোতির্ময় মুখার্জী
আমার লেখা ? না, লেখার আমি ?
দ্বন্দ্বটা বেশ প্রাচীন
উত্তরটাও অজানা নয়
তবু বারবার হাঁটু মুড়ে বসি তার সামনে
ও আমাকে আয়না দেখায়
আমি ওকে
[প্রাইম-টাইম]
শান্তুনু গঙ্গারিডি
বিপণ্যতার প্রাইম-টাইমে ঈশ্বরের হাতে গড়া রুটি
পরিমাণ মতো ক্যাপসিকামাতুর টমটম টমাটর।
বিলায়েতি মাটির জানেমন জান-বাহন
দলঝুট পাতাবাহারের বাহারি ওয়েব-জিন্
কোলাজিত পাৎলুনের অনন্ত বাহার
মুখরোচক টোটোরিক্সার ফটোফিনিক্স ভার্টিব্রা।
মিশ্রণ তৈরি হতে হতে অনায়াসে ধরা দেয় শ্রেণীকক্ষের কবন্ধ প্রবণতা।
ম-ছন্নছাড়া
সুনীল মাইতি
মাঝে----
খরস্রোতা নদী--
এ পার থেকে ও পারে যেতে চাও যদি,
চার খন্ড বাঁশ দিয়ে বাঁধা আছে ভাড়া।
একা কখন--- টুপ করে পড়বে ঝরে---
হয়ত মাঝ রাতে কিংবা কাকভোরে,
পারাপারে যেতে সঙ্গী করো তাকে,
নইলে তুমি ছন্নছাড়া।।
বদল
সৈয়দ মাহ: সাবির আলী
ঝড়ের ভয়ে,
ধুলো মাখা খামারটাতে গিরগিটির রঙ স্থির।
ছাতা আগেভাগে বন্ধ।
কাক ডাক দিচ্ছে,মিষ্টি স্বরে কুহঃ কুহঃ কুহঃ।
স্পষ্টকথা
অর্পিতা ভট্টাচার্য্য
আমার প্রেমিক কালো কদাকার
যুক্তিবাদী স্পষ্ট ।
তোমার প্রেমিক কলির কেষ্ট
রাধার প্রেমে নষ্ট ।
মম
অঞ্জলি দেনন্দি
সময় তখনই হয় সুসময়
যখন কথা কয় সুহৃদয়।
যখন হয় চেতনার সূর্যোদয়।
যখন মন-গগন হয় প্রেমময়
গল্প
-----------------
শহীদ
শহীদ
সৌমেন সরকার
বিজ্ঞানী জগন্নাথ সেনকে সকলেই চেনে।নামকরা ভাইরাস সায়েন্টিস্ট,রিসার্চ করেন বহু অজানা বিষয়ে।কিন্তু,তার দ্বিতীয় রূপটা হয়ত কেউ জানেনা।আর কোনদিন হয়ত কেউই জানতে পারতনা যদি তার স্ত্রী প্রমীলা দেবী তার এক আমেরিকান ক্লায়েন্টের সাথে তার কথাবার্তা না শুনতেন।এখন জগন্নাথ বাবু এমন একটা ভাইরাস তৈরী করছেন যা দিয়ে মানুষকে অনায়াসেই অনির্দিষ্ট কালের জন্য নিজের বশে রাখা যায়।
কথাবার্তা শেষ হলে প্রমীলা দেবী হঠাৎই ঘরে ঢুকে জগন্নাথ বাবুর কাছ থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে সার্চ করতে করতে জিজ্ঞাসা করলেন,"এসব কি ডিয়ার?What's going on?"
জগন্নাথ বাবু একটুও না অপ্রস্তুত হয়ে জবাব দেন-"এই ভাইরাসটা আমেরিকায় বিক্রি করলে একশো কোটি পাব।"
-"মানে?ওই ভাইরাস দিয়ে তো ওরা আমাদের দেশকেই আক্রমণ করতে পারে?"
-"তাতে আমাদের কি?"
-"তুমি তোমার দেশের সাথে এমন করতে পারনা।এটা শুধু পাপই না,অন্যায়।আর আমি বেঁচে থাকতে এমন হতে দেবনা।"
-"কি সব যা তা বলছ?সর এখান্ থেকে।আমাকে এই সপ্তাহের মধ্যেই ডেলিভারী দিতে হবে।"
-"আমি তোমাকে এমন দেশদ্রোহিতা করতে দেবনা।"
এই বলে প্রমীলা দেবী ফলকাটা ছুরিটা হঠাৎ বিঁধিয়ে দেন জগন্নাথ বাবুর বুকে।ততক্ষণে জগন্নাথ বাবুও তার শ্যুটের পকেট থেকে রিভলবারটা বার করে গুলি করেছেন তার স্ত্রীকে।দু-জনেই মারা গেলেন।
এইভাবে এক ভয়ঙ্কর ক্ষতির হাত থেকে দেশকে বাঁচালেন প্রমীলা দেবী,নিজের স্বামীক আপন হাতে হত্যা করে।তবে,তিনিও কি পাবেন শহীদের স্বীকৃতি?
প্রতিফলন
সঞ্জয় ঘোষ
"বড়ো পুরোহিত মশায়, আমি কিন্তু দেখেছি..!হেব্বি মস্তি করলেন,বলুন!?গতকাল গভীর রাতে,আপনি বড়োবাড়ির মেয়ে কে মুখ বেঁধে, ঝোঁপের আড়ালে নিয়ে গিয়ে, উলঙ্গ করে..............!!"(সহকারী পুরোহিত)
"...চুপচুপচুপপপপ..চুপ করো,মনটাকে অন্যমনস্ক করো না।মায়ের মহাদশমী পুজোর ব্যঘাত ঘটাবে নাকি...!!?"(বড়ো পুরোহিত)
মহাদশমীর শেষ অধ্যায়ের পুজোর প্রস্তুতি চলছে।শেষ অধ্যায়ে, তখন মা কে আরশিতে স্ব-রূপের প্রতিফলন দেখানোর নিয়ম পালন চলছে।
প্রতি বারের মতো এবারেও, বড়ো পুরোহিত মায়ের প্রতিফলিত রূপ দেখবার জন্য অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে এগিয়ে গেলে, তিনি আরশিতে প্রতিফলিত রূপে দেখতে পান ঝোঁপের আড়ালে পড়ে থাকা কাল রাতে হওয়া অকথ্য অত্যাচারিতা কে।
হঠাৎই, পাড়ার ছেলেরা দৌঁড়ে এসে খবর দিল, ঝোঁপের আড়ালে পড়ে থাকা ধর্ষিতা দূর্গার মৃতদেহ সম্পর্কে।ধর্ষিতার মৃতদেহ নিয়ে সকলে মন্ডপে এসে উপস্হিত হল।
অন্যদিকে, সহকারী পুরোহিতের হঠাৎ চিৎকার শুনে,মন্ডপে উপস্হিত দর্শকগন দেখল, বড়ো পুরোহিত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরন করেছেন। আর সহকারী পুরোহিত সেই চিৎকারের পর কন্ঠস্বর থেকে ধ্বনি নির্গত হবার সামর্থ্য পুরোপুরিভাবে হারিয়ে ফেলেছেন।
এইভাবেই,কালের ধ্বংসের মাধ্যমে বিসর্জনের জলে দূর্গার আগুন স্নিগ্নতার উক্তি রচনা করেছিল।
প্রত্যুত্তর
শুদ্ধেন্ধু চক্রবর্তী
বিতান খবরটা পড়ে মনে মনে শিউড়ে উঠল।তার মোবাইলে জ্বলজ্বল করছে।বিয়াল্লিশ জন বীর সৈনিক মুহূর্তে শহীদ।মন বিষাদে ভরে গেল।রক্ত ফুটছে তার।ঘনঘন মেসেজ আসছে ফোন।রাজপথজুড়ে ছিন্নভিন্ন দেহ।চাপ চাপ রক্ত।এতগুলো মৃত্যু ।বিনা কারণে।জিহাদ।থুঃ।
সমীরণ ভোরবেলা টিভি চালিয়ে দিতেই তার চোখ জ্বলে উঠলো উত্তেজনায় ।বেশ হয়েছে।তিনশোজন এক নিমেষে খতম।মুখের ওপর জবাব।সমীরণ দেখতে ফায় তার মোবাইলে মেসেজগুলোতে নানান ভঙ্গিতে বাঁধা ডেডবডি।থুঃ।
বিতান আর সমীরণের দেখা হয়ে গেল শহরের ব্যস্ত কফিশপে।বিতান কম্পিউটার এক্সপার্ট, সমীরণ কেমিস্ট।আসলে তারা বাল্যবন্ধু ।কাপ হাতে দুজনেই বলে উঠল চিয়ারস।অদলবদল হলো বডিগুলো।"তিনশো নয়,তিন হাজার মাথা চাই।"তৈমুরের মতো বলল বিতান।"চল্লিশের বদলে চারশো।"সমীরণ চন্ডাশোকের মতো বলে উঠল।আরেকবার চিয়ার্স করতে কাপঠোকাঠুকি হয়ে গেল।ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ল কাপদুটো।উত্তেজনায় ঠোকাঠুকি বেশি জোড়ালো হয়ে গেছে।ওরা দুজনে বুঝতে পারেনি।
ছড়া
-----------------
ভুতের ভর
শুভম রায়
বইছে হাওয়া শীতল শীতল
লাগছে বড়ো ভয়
ঠিক বারোটার পরে জানি
শরীর কেমন হয়
হচ্ছে মনে ধরল ভূতে
ভর করল প্রেতে
এদের জ্বালায় ক'দিন ধরে
পারছি নাকো খেতে
ভূতটা এমন কেলটে পরা
জানব কি করে?
তালের পিঠা
এম ডি সবুজ
তাল পড়ে দুপদাপ
ছুটে আয় চুপচাপ
ঘরে বসে ঠিকঠাক
পিঠা খায় টুকটাক।
ফড়িং
ভুতের ভর
শুভম রায়
বইছে হাওয়া শীতল শীতল
লাগছে বড়ো ভয়
ঠিক বারোটার পরে জানি
শরীর কেমন হয়
হচ্ছে মনে ধরল ভূতে
ভর করল প্রেতে
এদের জ্বালায় ক'দিন ধরে
পারছি নাকো খেতে
ভূতটা এমন কেলটে পরা
জানব কি করে?
তালের পিঠা
এম ডি সবুজ
তাল পড়ে দুপদাপ
ছুটে আয় চুপচাপ
ঘরে বসে ঠিকঠাক
পিঠা খায় টুকটাক।
ফড়িং
মৌসুমি ভৌমিক
ইরিং বিড়িং তিড়িং চা
ফড়িং তুই উড়ে যা ।
ইরিং বিড়িং ঘাস খা
সবুজ সবুজ দেখে খা।
ফুরুৎ ফুরুৎ ঘাস ফড়িং
কেন নাচিস তিড়িং তিড়িং ।
সবুজ সবুজ ঘাস রং
ঘাসফড়িং এর উড়িং ঢং।
লাগামছাড়া
লিপি ঘোষ হালদার
ভারতীয় ঘোড়ারা মারছে দ্যাখো চাঁটা
পাকিস্তান বাঁধল গরু কাশ্মীরে তার খোঁটা!
জঙ্গি রাখাল সেনার বেশে নিয়ে লাঠিসোঁটা!
জঙলী বুনো পশুর দল মিথ্যে তাদের ছোটা।
জঙ্গিগুলো সঙ্গী খোঁজে ঘুরতে চায় মুম্বাই
ভিলেনের রোলে তারা শুটিং এ যায় দুবাই।
অভিনেতা-নেত্রীরা সব আছেন মন্ত্রীসভায়,
চীনদেশীয় ব্যাঙ ডাকে আমেরিকান ভাষায়!!
গদ্য
ইরিং বিড়িং তিড়িং চা
ফড়িং তুই উড়ে যা ।
ইরিং বিড়িং ঘাস খা
সবুজ সবুজ দেখে খা।
ফুরুৎ ফুরুৎ ঘাস ফড়িং
কেন নাচিস তিড়িং তিড়িং ।
সবুজ সবুজ ঘাস রং
ঘাসফড়িং এর উড়িং ঢং।
লাগামছাড়া
লিপি ঘোষ হালদার
ভারতীয় ঘোড়ারা মারছে দ্যাখো চাঁটা
পাকিস্তান বাঁধল গরু কাশ্মীরে তার খোঁটা!
জঙ্গি রাখাল সেনার বেশে নিয়ে লাঠিসোঁটা!
জঙলী বুনো পশুর দল মিথ্যে তাদের ছোটা।
জঙ্গিগুলো সঙ্গী খোঁজে ঘুরতে চায় মুম্বাই
ভিলেনের রোলে তারা শুটিং এ যায় দুবাই।
অভিনেতা-নেত্রীরা সব আছেন মন্ত্রীসভায়,
চীনদেশীয় ব্যাঙ ডাকে আমেরিকান ভাষায়!!
গদ্য
----------------
রাধপুরান
শাস্বতী সরকার
তুমি কি এই একুশ শতকেই একটি রাধাপুরাণ লিখতে চাও,যেখানে ষোলহাজার গোপিনী নয়,ষোলহাজার গোপবালক রাধাকে কামনা করছেন সাবালক হওয়ার জন্য? ছি ছি ছি, কানাই! শেষ পর্যন্ত তুমি এ কি করলে! নিজ স্ত্রীকে,নিজ প্রেমিকাকে বারাঙ্গনা বানিয়ে ছাড়লে?! ঠিক যেভাবে একদিন তোমাকে বানিয়েছিল রাধা, ষোলহাজার গোপিনীর অঙ্কশায়িত? হা হা!হা! কানাই, ষোলহাজারবার তোমার পুরুষদন্ডটি ব্যবহার হয়েছিল শুধু, ষোলহাজার প্রেম পাওনি।আমি, এ যুগের রাধা, মরালগামিনী, গ্রীবা উঁচু করে জানিয়ে দিলাম, অপাপবিদ্ধ মন্থনদন্ডটিকেই আমি শুধু অমৃতসেবনের অধিকার দেব, তফাৎ যাও আর বাকি সব।তফাৎ যাও! আমি আসছি হে,অমৃতের পুত্র! প্রস্তুত থাকো হে,প্রস্তুত থাকো, তোমার অঙ্কশায়িনী হতে আমি আসছি।
প্রবন্ধ
রাধপুরান
শাস্বতী সরকার
তুমি কি এই একুশ শতকেই একটি রাধাপুরাণ লিখতে চাও,যেখানে ষোলহাজার গোপিনী নয়,ষোলহাজার গোপবালক রাধাকে কামনা করছেন সাবালক হওয়ার জন্য? ছি ছি ছি, কানাই! শেষ পর্যন্ত তুমি এ কি করলে! নিজ স্ত্রীকে,নিজ প্রেমিকাকে বারাঙ্গনা বানিয়ে ছাড়লে?! ঠিক যেভাবে একদিন তোমাকে বানিয়েছিল রাধা, ষোলহাজার গোপিনীর অঙ্কশায়িত? হা হা!হা! কানাই, ষোলহাজারবার তোমার পুরুষদন্ডটি ব্যবহার হয়েছিল শুধু, ষোলহাজার প্রেম পাওনি।আমি, এ যুগের রাধা, মরালগামিনী, গ্রীবা উঁচু করে জানিয়ে দিলাম, অপাপবিদ্ধ মন্থনদন্ডটিকেই আমি শুধু অমৃতসেবনের অধিকার দেব, তফাৎ যাও আর বাকি সব।তফাৎ যাও! আমি আসছি হে,অমৃতের পুত্র! প্রস্তুত থাকো হে,প্রস্তুত থাকো, তোমার অঙ্কশায়িনী হতে আমি আসছি।
প্রবন্ধ
----------------
বাংলার ইতিহাস
সায়ন দাস
‘বাংলা’ শব্দটির সঙ্গে একবার সপ্তমী, আর একবার ষষ্ঠী বিভক্তির হেরফের ঘটিয়ে ‘বাংলা’ কথাটি একাধারে একটি ভাষা এবং একটি ভূখণ্ডের অর্থবহ হয়ে যায়। এর ভিতর দিয়ে বাংলা ভাষা, বাংলা নামক এলাকা, ওই ভাষাটির ব্যবহারকারী হিসেবে বাঙালির পরিচিতি খুঁজে নেওয়া যায়। বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে সরল এবং নিরীহ মনে হলেও তার ভিতরে পরতে পরতে জড়িয়ে আছে জটিলতা। সেই জটিলতা বুঝতে গেলে ইতিহাসের ভিতরে ঢুকতে হয়।
ভাষা হিসেবে বাংলার প্রাচীনত্ব মেরেকেটে খ্রিস্টীয় দশম-একাদশ শতকের আগে নিয়ে যাওয়া কঠিন। এই সময়ে বাংলা বলে কোনও এলাকা নেই। অথচ ইতিহাসবিদরা হামেশাই বাংলার ইতিহাস আলোচনা করেন। ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্টের আগে বাংলা বলতে এখনকার পশ্চিমবঙ্গ এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের এলাকা মিলিয়ে একটি অঞ্চল ছিল। এই ভূখণ্ডটি আয়তনে এখনকার ফ্রান্সের চেয়ে বড়। ব্রিটিশ আমলের ‘বাংলা’ নামক প্রদেশটির উদ্ভব মুঘলকালীন বাংলা সুবা থেকে। তার আগেও সুলতানি শাসনের সময় এই ভূখণ্ডটির ঐতিহাসিক পরিচিতি চতুর্দশ শতকের আগে নিয়ে যাওয়া মুশকিল। অথচ ‘বাংলা’ (ইংরেজি ‘বেঙ্গল’, অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় ‘বেঙ্গালা’) শব্দটির উৎপত্তি ‘বঙ্গাল’ থেকে। ‘বঙ্গ’ নামক জনপদের সঙ্গে ‘আল’ শব্দটি জুড়ে ‘বঙ্গাল’ কথাটির উৎপত্তি। ভাটির দেশ এই বঙ্গাল, প্রচুর বৃষ্টির কারণে এলাকাটি বছরের অনেক সময়ে জলমগ্ন। জল আটকানোর তাগিদেই আলের বহুল ব্যবহার সেই জনপদে। ‘বঙ্গ’ নামক জনপদ তথা ওই জনপদের বাসিন্দাদের উল্লেখ আছে খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম-সপ্তম শতকের পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে, যদিও ভূখণ্ডটির প্রতি হেয় মনোভাব তাতে প্রকট। ‘বঙ্গ’ নামটির প্রাচীনত্ব নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই ‘বঙ্গ’— যার থেকে বঙ্গাল, তথা বাঙ্গালা শব্দটির উদ্ভব— কি সুপ্রাচীন কালে ১৯৪৭–এর অবিভক্ত বাংলা নামক এলাকাটির সমার্থক? এর স্পষ্ট উত্তর: না। ইতিহাসের নিরিখে আরও একটু তল্লাশি করা যাক।
চৈনিক পরিব্রাজক যুয়ান জাং (হিউয়ান ৎসাং) ৬৩৭ খ্রি: নাগাদ এই অঞ্চলে পরিভ্রমণ করছিলেন। প্রধানত বৌদ্ধ বিহারগুলি দেখার তাগিদে। তাঁর বিবরণ অনুযায়ী তিনি কজঙ্গল (রাজমহল অঞ্চল) থেকে যান পু্ণ্ড্রবর্ধন, (পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উত্তরভাগ) তার পর কামরূপ (ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অসম), সেখান থেকে সমতট (বাংলাদেশের নোয়াখালি-কুমিল্লা এলাকা)। তার পর তাম্রলিপ্ত (পূর্ব মেদিনীপুর), সব শেষে কর্ণসুবর্ণ (শশাঙ্কের রাজধানী, মুর্শিদাবাদ জেলা)। পরে তিনি যাত্রা করেন ওড্রদেশে (ওড়িশা)। এর মধ্যে পাঁচটি জনপদের উল্লেখ আছে। কিন্তু বাংলা নামক একটি নির্দিষ্ট এলাকা কই?
এর চার শতাব্দী পর দাপুটে দক্ষিণ ভারতীয় রাজা রাজেন্দ্র চোল (১০১২-১০৪৪ খ্রি:) গাঙ্গেয় এলাকা জয় করলেন ১০২৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ, তাই তাঁর উপাধি গঙ্গৈকোণ্ড (গাঙ্গেয় অঞ্চল বিজেতা)। রাজেন্দ্রের হাতে পরাজিত শাসকেরা হলেন তণ্ডবুত্তি (দণ্ডভুক্তি: দাঁতন, মেদিনীপুর) তক্কনলাঢ়ম্ (দক্ষিণরাঢ়), উত্তিরলাঢ়ম্ (উত্তররাঢ়) এবং বঙ্গাল-এর (বরিশাল-ঢাকা-বিক্রমপুর, বাংলাদেশ) শাসকেরা। এঁদের মধ্যে পালবংশীয় প্রথম মহীপালও আছেন। তিনি কিন্তু সমগ্র বাংলার শাসক নন। অন্য দিকে বঙ্গালের শাসকও বাংলার একটি স্থানীয় শক্তি মাত্র। রাজেন্দ্র চোলও তাই বাংলা জয়ের কথা বলেন না। তিনি বরং গাঙ্গেয় এলাকায় সফল অভিযানের কৃতিত্ব দাবি করেন।
অতএব, উনিশ শতক থেকে বাংলার অতীত অনুধাবনের যে নিরলস প্রয়াস শুরু হল, তার অনেকটাই জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ দ্বারা চালিত— সেখানে অবিভক্ত বাংলার এলাকাকে মাথায় রেখে সুদূর অতীতের প্রেক্ষাপটেও সেই বড় এলাকাটিকে বাংলা বলে ইতিহাসবিদরা চিহ্নিত করে দিলেন। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা (ভারতের অঙ্গরাজ্য) এবং জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের সমাহারে একটি এলাকাকে উনিশ ও বিশ শতকের মাপকাঠিতে বাংলা তথা বেঙ্গল হিসেবে অভিহিত করা হল।
কিন্তু ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের আগে এই রকম একীকৃত নিটোল একটি ভূখণ্ড হিসেবে বাংলার অস্তিত্ব নেই। ছিল পাঁচটি উপবিভাগ: ১) পুণ্ড্র বা পুণ্ড্রবর্ধন (অবিভক্ত বাংলার উত্তরাংশ), ২) রাঢ় (ভাগীরথীর পশ্চিম এলাকা যার অনেকটাই পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত) ৩) বঙ্গ (বাংলাদেশের ঢাকা-বিক্রমপুর-ফরিদপুর), ৪) সমতট (বাংলাদেশের নোয়াখালি-কুমিল্লা এলাকা) এবং ৫) হরিকেল (চট্টগ্রাম ও সন্নিহিত এলাকা, বাংলাদেশ)। ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের আগে এই পাঁচটি উপবিভাগের উপর কোনও একটি রাজশক্তির রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ছিল না। সামাজিক, আর্থিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে উপবিভাগগুলির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ক্রমেই উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। সাদৃশ্য যে এই বিভাগগুলির মধ্যে একেবারে নেই তা নয়। কিন্তু ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিতে বৈচিত্র সুপ্রচুর। অর্থাৎ আঞ্চলিক ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাচীন বাংলার অবস্থা একই সঙ্গে প্রাণবন্ত এবং জটিল। তার স্থানিক লক্ষণগুলির বিশেষ তাৎপর্য আছে।
প্রাচীনতম পর্ব থেকে ১২০০-১৩০০ খ্রি: পর্যন্ত বাংলা নামক ভূখণ্ডটির বহুমাত্রিক এবং জটিল অবস্থাটিকে পর্যালোচনা করার ও ফুটিয়ে তোলার আগ্রহে বাংলাদেশের এশিয়াটিক সোসাইটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছেন। ‘হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ’ এই গ্রন্থাবলিতে এ পর্যন্ত আলোচিত ও প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত এবং স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের গত চার দশকের ইতিহাস। ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশের এই সারস্বত প্রতিষ্ঠানটি এ বার উদ্যোগ নিয়েছেন বাংলার আদিপর্বের ইতিহাস রচনায় এবং তার পুনর্মূল্যায়নে। বলাই বাহুল্য, নিছক জাতিরাষ্ট্রের মাপকাঠিতে এই সুদূর অতীতকে ধরা অসম্ভব। কারণ তখন জাতিরাষ্ট্রের অস্তিত্বই ছিল না। তাই গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই ভূখণ্ডের উপবিভাগগুলির সম্যক ঐতিহাসিক পর্যালোচনা করাই দুই খণ্ডে বিধৃত গ্রন্থটির প্রধান লক্ষ্য। গোটা উপমহাদেশে এটি একমাত্র অ়ঞ্চল যা উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে সাগর পর্যন্ত প্রসারিত। জীবনের প্রায় এমন কোনও দিক নেই, যা সুদূর অতীতকাল থেকেই বাংলার নদনদী দ্বারা প্রভাবিত হয়নি।
বাংলাদেশের তরফে এই পদক্ষেপ নেওয়া হল, অথচ তা বাংলাদেশের বর্তমান ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে যে আটকে রাখা হল না, তাতে ইতিহাসবোধ যথাযথ মান্যতা পেয়েছে। ২০০২ সালে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি সিরাজুল ইসলামের সম্পাদনায় দশ খণ্ডে, ইংরেজি ও বাংলায় আলাদা করে ‘বাংলাপিডিয়া’ নামে যে কোষগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন, সেখানেও জাতিরাষ্ট্রের মাপকাঠিতে আলোচনা আটকে রাখা ছিল না। সেই প্রাথমিক প্রয়াসের পূর্ণতর পরিণত রূপ পাওয়া যাবে নতুন প্রকাশনাটিতে। যে উদ্দেশ্যে মহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এবং আহমেদ হাসান দানীর উদ্যোগে ঢাকায় এশিয়াটিক সোসাইটি গড়ে উঠেছিল, তাকে অন্তত আংশিক বাস্তবায়িত করাও এই নতুন ইতিহাস গ্রন্থটির আদর্শ। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসচর্চায় যাঁদের ভূমিকা অগ্রপথিকের, তাঁদের গবেষণা নতুন ইতিহাস গ্রন্থটির জন্য একই সঙ্গে ভিত্তি এবং প্রস্থানপর্ব। কালিদাস দত্তের কৃতিত্ব যেমন স্মরণীয় এ ক্ষেত্রে, একই ভাবে উজ্জ্বল হয়ে থাকে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রাধাগোবিন্দ বসাক, রমেশচন্দ্র মজুমদার, বিনয়চন্দ্র সেন, সরসীকুমার সরস্বতী, নীহাররঞ্জন রায়, দীনেশচন্দ্র সরকার, ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখের অসামান্য অবদান।
বস্তুত, রাজশাহির বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি এবং কলকাতার দুটি প্রতিষ্ঠান— বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, এশিয়াটিক সোসাইটি— না থাকলে এই জাতীয় প্রয়াস নেওয়াই অসম্ভব হত। অগ্রজ ইতিহাসবিদরা উনিশ এবং বিশ শতকে বাংলার অতীত উদ্ধারে ব্রতী হয়েছিলেন পরাধীন দেশের লুপ্ত গৌরব দর্শানোর অভীপ্সায়। বঙ্কিমচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথের ইতিহাসচেতনাও তাঁদের অনেকাংশেই উদ্বুদ্ধ করেছিল। তারই ফসল রাখালদাসের ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’, রমেশচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত ‘হিস্ট্রি অব বেঙ্গল’ (প্রথম খণ্ড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) এবং নীহাররঞ্জন রায়ের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’। গ্রন্থগুলির শিরোনাম থেকে বোঝা যাবে, নীহাররঞ্জন ছিলেন তাঁর সমকালীন ও পূর্বসূরি ইতিহাসবিদদের ধারণা এবং রীতিপদ্ধতির থেকে অনেকটাই আলাদা। তাঁর প্রধান অন্বিষ্ট অতীতের সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক জীবন, রাজবৃত্ত সেখানে গৌণ।
ইতিহাস রচনায় শেষ কথা বলে কিছু নেই, ইতিহাসের চূড়ায় সত্য প্রতিষ্ঠা করাও অসম্ভব। তাই নতুন আবিষ্কৃত তথ্যের আলোকে, অতীতের বাংলা নিয়ে নতুন কথা বলার সুযোগ যথেষ্ট। সেই কারণেই এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ দুই খণ্ডে ইংরেজিতে (অদূর ভবিষ্যতে বইটি বাংলাতেও প্রকাশিত হবে) বাংলার সুপ্রাচীন অতীতের সামগ্রিক আলোচনায় উদ্যোগী হয়েছেন। টাটকা, আকর তথ্য গত চার দশকে পরিমাণে বেড়েছে, আকর তথ্যের রকমফেরও উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে পুরাতাত্ত্বিক তথ্যপঞ্জি, লেখমালা, মুদ্রা এবং শিল্পসম্ভারের তথ্য উদ্ঘাটনে এ-পার ও-পার দুই বাংলাতেই বহু নতুন কথা জানা গিয়েছে। তাই পুরাতন এবং নব্যপ্রস্তর যুগে— বিশেষত লিখিত উপাদান আসার আগে— বাংলার মানুষের জীবন, জীবিকা, সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির ছবি আগের তুলনায় বদলে যেতে বাধ্য।
দুইটি বিষয়ে মন্তব্য এখানে দরকারি। প্রস্তর যুগে এবং তাম্রাশ্মীয় আমলে পশ্চিমবঙ্গের প্রত্ন সামগ্রীর সঙ্গে বিহার ও ঝাড়খণ্ডের সাযুজ্য যেমন দেখা যায়, তেমন বাংলাদেশের উত্তরপূর্ব এলাকার অতি প্রাচীন হাতিয়ার এবং তৈজসপত্রের সঙ্গে উত্তরপূর্ব সীমান্তবর্তী অ়ঞ্চল এবং মায়ানমারের বস্তুগত সংস্কৃতির তালমিলও নজরে পড়বে।
দ্বিতীয়ত, সাম্প্রতিক গবেষণা পদ্ধতি অনুযায়ী পুরাবস্তু কেবলমাত্র প্রাগিতিহাসের মানুষকে বোঝার জন্য জরুরি নয়। লিখিত তথ্যরাজি থাকলেও উৎখনন এবং অনুসন্ধান থেকে পাওয়া প্রত্নবস্তুর সাক্ষ্য একান্ত প্রয়োজন নগরায়ণ বোঝার জন্য। তাই বাংলার প্রাচীনতম তিনটি নগরের পরিচয় পাওয়া যাবে বাণগড় (পশ্চিমবঙ্গ), মহাস্থান (বাংলাদেশ) এবং ওয়াড়ি বটেশ্বর-এর (ঢাকার কাছে) উৎখনন থেকে। অনেকগুলি লেখ এবং তাম্রশাসনের পাঠোদ্ধার করা হয়েছে সাম্প্রতিক দশকগুলিতে। আগে ইতিহাসবিদগণ মূলত লেখ/তাম্রশাসনের সাক্ষ্য ব্যবহার করতেন রাজবংশের ইতিহাস লেখার জন্য। এখন লেখমালার আলোকে রাজবৃত্ত ছাড়াও নিয়মিত রচিত হয় সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাস।
একটি-দু’টি উদাহরণ দেওয়া যাক। ৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বিক্রমপুরের চন্দ্রবংশীয় শাসক শ্রীচন্দ্র (৯২৫-৭৫ খ্রি.) শ্রীহট্টে এক বিশাল ব্রাহ্মণ নিবেশন (‘ব্রহ্মপুর’) তৈরি করার জন্য তাম্রশাসন জারি করে জমিজমা দিলেন। ছয় হাজার ব্রাহ্মণের বসতির ব্যবস্থা হল সেখানে। কিন্তু ব্রাহ্মণ তো কায়িক শ্রম করেন না। তাই জমি বরাদ্দ হল কায়স্থ (করণিক) গণক (হিসাবরক্ষক), স্থপতি, বৈদ্য প্রভৃতি পেশাদারদের জন্য। তারই সঙ্গে থাকলেন বহু কর্মকার, কুম্ভকার, শঙ্খবাদক, ঢক্কাবাদক, নাপিত, কর্মকার, এমনকি ভৃত্য (কর্মকর) এবং দাসী (চেটিকা)। উপাস্য দেবতাদের মধ্যে আছেন বিরলদর্শন ব্রহ্মা। সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক হল অগ্নি, মহাকাল, যোগেশ্বর এবং জৈমিনীর (শেষোক্ত জন পূর্বমীমাংসাকার দার্শনিক, দশম শতকে শ্রীহট্টে দেবতায় পর্যবসিত) উপাসনা। উপাস্য দেবতা অভিন্ন হলেও দুটি ভিন্ন মঠে তাঁদের আরাধনার ব্যবস্থা হল: একটি বঙ্গালদেশীয়দের মঠ, অপরটি দেশান্তরীয় মঠ। বাইরে থেকে শ্রীহট্টে লোক এসেছিল, তা বোঝাই যায়। হয়তো কিছু সামাজিক-সাংস্কৃতিক টানাপড়েনও ঘটে থাকবে, তাই ভিন্ন ভিন্ন মঠে অভিন্ন দেবতাসমূহের আরাধনার এক বিচিত্র নজির রয়ে গেল। লক্ষণীয় যে, রাজা শ্রীচন্দ্র বৌদ্ধ; যাঁর বিশেষ অনুরোধে ব্রহ্মপুরের জমি মঞ্জুর হল, তিনি এক বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ। অথচ ব্রহ্মপুরে উপাসনার ব্যাপারে বুদ্ধ ও বিষ্ণুর উপস্থিতি পর্যন্ত নেই। এক বহুমাত্রিক রংদার এবং জটিল পরিস্থিতির সাক্ষ্য এখানে হাজির।
ধর্মাচরণের জন্য নিষ্কর ভূসম্পদ দেওয়ার রাজকীয় তথা প্রশাসনিক দলিলের সংখ্যা প্রচুর। পুণ্ড্র এবং রাঢ় এলাকায় এক জন বা কয়েক জন ব্রাহ্মণের উদ্দেশে নিষ্কর জমি দেওয়ার নজির বেশি, মেঘনা নদীর পূর্ব দিকে একই রকম ভূমিদানের ক্ষেত্রে প্রবণতা ভিন্ন। দানগ্রহীতা সাধারণত কোনও ব্যক্তি নন, বরং কোনও ধর্মপ্রতিষ্ঠান (মঠ বা বিহার)। জমি দানের দলিলের একেবারে শেষ দিকে জমির সীমানা সংক্রান্ত খুঁটিনাটি বিবরণ থাকে। আপাত-নীরস সেই তথ্য নিষ্কাশন করে ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় যে অভিনব গবেষণা করেন, তা থেকে গ্রামীণ এলাকার বসতি-বিন্যাস মূর্ত হয়ে ওঠে। গ্রামগুলি দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন, আবদ্ধ এবং স্বয়ম্ভর নয়, বরং একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং পরস্পর নির্ভরশীল ছিল। তাই এই সিদ্ধান্তটি চমকে দেওয়ার মতো।
আঞ্চলিক বৈচিত্রের আর এক উদাহরণ মুদ্রা ব্যবস্থায়। খ্রি: ষষ্ঠ-সপ্তম শতক থেকে বাংলার স্বর্ণমুদ্রায় খাদের পরিমাণ বেড়েই চলেছে, অষ্টম শতক থেকে সোনার টাকা কার্যত উধাও হয়ে গেল। নীহাররঞ্জন রায় এবং রামশরণ শর্মা স্বর্ণমুদ্রার অদর্শনে দূরপাল্লার সমুদ্রবাণিজ্যের অধোগতি দেখেছিলেন। পাল-সেন বংশীয় রাজারা মুদ্রা জারি করায় অনীহা দেখালেও, সমতট-হরিকেল অ়ঞ্চলে সপ্তম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত উচ্চমানের রৌপ্যমুদ্রার ব্যবহার ছিল অব্যাহত। দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য উপাদান ছিল কড়ি। এই কড়ি কিন্তু বাংলায় পাওয়া যায় না। তা আসত সুদূর মলদ্বীপ থেকে জলপথে।
দৈনন্দিন জীবনের যে ছবি এক কালে ফুটিয়েছিলেন নীহাররঞ্জন রায়, তা বর্তমানে আরও সমৃদ্ধ হয়েছে চন্দ্রকেতুগড়, তাম্রলিপ্ত এবং ময়নামতী (কুমিল্লা, বাংলাদেশ) থেকে আবিষ্কৃত ভূরি পরিমাণ পোড়ামাটির ভাস্কর্যের দ্বারা, যাতে শিল্পের দেশজ ছাপটি বিধৃত। শিল্পকলা তো বটেই, ধর্মীয় জীবন বোঝার জন্যও প্রতিমাগুলির উপযোগিতা প্রশ্নাতীত। ধর্মীয় জগতে বৌদ্ধধর্ম কী ভাবে ক্রমে গৌণ হয়ে গেল ব্রাহ্মণ্য-পৌরাণিক ভক্তিমূলক সম্প্রদায়ের দাপটে, তা-ও এক জটিল ও বর্ণময় কাহিনি। এখানে উল্লেখ করা উচিত, নালন্দা, বিক্রমশীলা এবং সোমপুর বিহার যখন অবসন্ন, তখনও কিন্তু ময়নামতী এবং চট্টগ্রাম এলাকায় বৌদ্ধধর্ম যথেষ্ট সজীব। অতি সম্প্রতি আবিষ্কৃত একটি লেখ জানান দেয় যে খ্রি: পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকে কুমিল্লা-নোয়াখালি এলাকায় সক্রিয় ছিল আজীবিক নামক শ্রমণগোষ্ঠীর একটি ধর্মপ্রতিষ্ঠান। এর আগে বাংলায় আজীবিকদের উপস্থিতি এত স্পষ্ট ভাবে জানা ছিল না।
এই সব আনকোরা নতুন তথ্যের আলোকে, পূর্বসূরিদের কাজকে খতিয়ে দেখে নতুন কথা বলার সুযোগ তথা প্রয়োজনীয়তা আছে। কিন্তু এই কর্ম কোনও এক ব্যক্তির সাধ্যাতীত, এর জন্য দরকার সামূহিক প্রচেষ্টা। তাই এই কাজে শামিল হয়েছেন বাংলাদেশ, ভারত, জাপান, চিন, ফ্রান্স, জার্মানি ও মার্কিন দেশের বিশেষজ্ঞরা। প্রথম খণ্ডে থাকছে প্রাচীন জনগোষ্ঠী তথা কৌমগুলির পরিচয়— অনেকটাই নৃতত্ত্বের ভিত্তিতে। আর আছে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান-আশ্রিত দীর্ঘ আলোচনা। দ্বিতীয় খণ্ডে সন্নিবিষ্ট হয়েছে বর্ণ-জাতিতে বিভাজিত অসাম্য-চিহ্নিত সমাজ, নারীর অবস্থান, দৈনন্দিন জীবনযাপন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মুদ্রাব্যবস্থা, ধর্মীয়-জীবন (ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ এবং জৈন সম্প্রদায়), শিল্পকলার কথা (স্থাপত্য-ভাস্কর্য, চিত্রকলা, মূর্তিতত্ত্ব), সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (সংস্কৃত, প্রাকৃতে রচিত এবং অবশ্যই চর্যাপদের পর্যালোচনা)। থাকছে অনেকগুলি মানচিত্র এবং আলোকচিত্র। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপিকা রোমিলা থাপারের মুখবন্ধ এবং বিশিষ্ট অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের প্রাককথন বইটিকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে।
জাতীয়তাবাদী জিগিরে যখন বিভেদ জাগিয়ে তোলা হচ্ছে, যখন বহুর মধ্যে এক খোঁজার মেঠো বুলি দিয়ে সব কিছু একাকার করে দেওয়ার দুরভিসন্ধি দেখা যাচ্ছে—তখন জাতিরাষ্ট্রের সঙ্কীর্ণ গণ্ডিকে অতিক্রম করার এ এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। আনন্দবাজার পত্রিকার দ্বাদশ বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে (১৯৩৩) রবীন্দ্রনাথ আহ্বান জানিয়েছিলেন: ‘স্বদেশেরে চাও যদি তারো ঊর্দ্ধ্বে ওঠো/ কোর না দেশের কাছে মানুষেরে ছোটো।’
জাতীয়তাবাদের চিৎকৃত এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের ওই উচ্চারণটিই দুই বাংলার ইতিহাসবিদদের এই উদ্যোগের চালিকাশক্তি।
বাংলার ইতিহাস
সায়ন দাস
‘বাংলা’ শব্দটির সঙ্গে একবার সপ্তমী, আর একবার ষষ্ঠী বিভক্তির হেরফের ঘটিয়ে ‘বাংলা’ কথাটি একাধারে একটি ভাষা এবং একটি ভূখণ্ডের অর্থবহ হয়ে যায়। এর ভিতর দিয়ে বাংলা ভাষা, বাংলা নামক এলাকা, ওই ভাষাটির ব্যবহারকারী হিসেবে বাঙালির পরিচিতি খুঁজে নেওয়া যায়। বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে সরল এবং নিরীহ মনে হলেও তার ভিতরে পরতে পরতে জড়িয়ে আছে জটিলতা। সেই জটিলতা বুঝতে গেলে ইতিহাসের ভিতরে ঢুকতে হয়।
ভাষা হিসেবে বাংলার প্রাচীনত্ব মেরেকেটে খ্রিস্টীয় দশম-একাদশ শতকের আগে নিয়ে যাওয়া কঠিন। এই সময়ে বাংলা বলে কোনও এলাকা নেই। অথচ ইতিহাসবিদরা হামেশাই বাংলার ইতিহাস আলোচনা করেন। ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্টের আগে বাংলা বলতে এখনকার পশ্চিমবঙ্গ এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের এলাকা মিলিয়ে একটি অঞ্চল ছিল। এই ভূখণ্ডটি আয়তনে এখনকার ফ্রান্সের চেয়ে বড়। ব্রিটিশ আমলের ‘বাংলা’ নামক প্রদেশটির উদ্ভব মুঘলকালীন বাংলা সুবা থেকে। তার আগেও সুলতানি শাসনের সময় এই ভূখণ্ডটির ঐতিহাসিক পরিচিতি চতুর্দশ শতকের আগে নিয়ে যাওয়া মুশকিল। অথচ ‘বাংলা’ (ইংরেজি ‘বেঙ্গল’, অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় ‘বেঙ্গালা’) শব্দটির উৎপত্তি ‘বঙ্গাল’ থেকে। ‘বঙ্গ’ নামক জনপদের সঙ্গে ‘আল’ শব্দটি জুড়ে ‘বঙ্গাল’ কথাটির উৎপত্তি। ভাটির দেশ এই বঙ্গাল, প্রচুর বৃষ্টির কারণে এলাকাটি বছরের অনেক সময়ে জলমগ্ন। জল আটকানোর তাগিদেই আলের বহুল ব্যবহার সেই জনপদে। ‘বঙ্গ’ নামক জনপদ তথা ওই জনপদের বাসিন্দাদের উল্লেখ আছে খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম-সপ্তম শতকের পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে, যদিও ভূখণ্ডটির প্রতি হেয় মনোভাব তাতে প্রকট। ‘বঙ্গ’ নামটির প্রাচীনত্ব নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই ‘বঙ্গ’— যার থেকে বঙ্গাল, তথা বাঙ্গালা শব্দটির উদ্ভব— কি সুপ্রাচীন কালে ১৯৪৭–এর অবিভক্ত বাংলা নামক এলাকাটির সমার্থক? এর স্পষ্ট উত্তর: না। ইতিহাসের নিরিখে আরও একটু তল্লাশি করা যাক।
চৈনিক পরিব্রাজক যুয়ান জাং (হিউয়ান ৎসাং) ৬৩৭ খ্রি: নাগাদ এই অঞ্চলে পরিভ্রমণ করছিলেন। প্রধানত বৌদ্ধ বিহারগুলি দেখার তাগিদে। তাঁর বিবরণ অনুযায়ী তিনি কজঙ্গল (রাজমহল অঞ্চল) থেকে যান পু্ণ্ড্রবর্ধন, (পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উত্তরভাগ) তার পর কামরূপ (ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অসম), সেখান থেকে সমতট (বাংলাদেশের নোয়াখালি-কুমিল্লা এলাকা)। তার পর তাম্রলিপ্ত (পূর্ব মেদিনীপুর), সব শেষে কর্ণসুবর্ণ (শশাঙ্কের রাজধানী, মুর্শিদাবাদ জেলা)। পরে তিনি যাত্রা করেন ওড্রদেশে (ওড়িশা)। এর মধ্যে পাঁচটি জনপদের উল্লেখ আছে। কিন্তু বাংলা নামক একটি নির্দিষ্ট এলাকা কই?
এর চার শতাব্দী পর দাপুটে দক্ষিণ ভারতীয় রাজা রাজেন্দ্র চোল (১০১২-১০৪৪ খ্রি:) গাঙ্গেয় এলাকা জয় করলেন ১০২৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ, তাই তাঁর উপাধি গঙ্গৈকোণ্ড (গাঙ্গেয় অঞ্চল বিজেতা)। রাজেন্দ্রের হাতে পরাজিত শাসকেরা হলেন তণ্ডবুত্তি (দণ্ডভুক্তি: দাঁতন, মেদিনীপুর) তক্কনলাঢ়ম্ (দক্ষিণরাঢ়), উত্তিরলাঢ়ম্ (উত্তররাঢ়) এবং বঙ্গাল-এর (বরিশাল-ঢাকা-বিক্রমপুর, বাংলাদেশ) শাসকেরা। এঁদের মধ্যে পালবংশীয় প্রথম মহীপালও আছেন। তিনি কিন্তু সমগ্র বাংলার শাসক নন। অন্য দিকে বঙ্গালের শাসকও বাংলার একটি স্থানীয় শক্তি মাত্র। রাজেন্দ্র চোলও তাই বাংলা জয়ের কথা বলেন না। তিনি বরং গাঙ্গেয় এলাকায় সফল অভিযানের কৃতিত্ব দাবি করেন।
অতএব, উনিশ শতক থেকে বাংলার অতীত অনুধাবনের যে নিরলস প্রয়াস শুরু হল, তার অনেকটাই জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ দ্বারা চালিত— সেখানে অবিভক্ত বাংলার এলাকাকে মাথায় রেখে সুদূর অতীতের প্রেক্ষাপটেও সেই বড় এলাকাটিকে বাংলা বলে ইতিহাসবিদরা চিহ্নিত করে দিলেন। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা (ভারতের অঙ্গরাজ্য) এবং জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের সমাহারে একটি এলাকাকে উনিশ ও বিশ শতকের মাপকাঠিতে বাংলা তথা বেঙ্গল হিসেবে অভিহিত করা হল।
কিন্তু ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের আগে এই রকম একীকৃত নিটোল একটি ভূখণ্ড হিসেবে বাংলার অস্তিত্ব নেই। ছিল পাঁচটি উপবিভাগ: ১) পুণ্ড্র বা পুণ্ড্রবর্ধন (অবিভক্ত বাংলার উত্তরাংশ), ২) রাঢ় (ভাগীরথীর পশ্চিম এলাকা যার অনেকটাই পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত) ৩) বঙ্গ (বাংলাদেশের ঢাকা-বিক্রমপুর-ফরিদপুর), ৪) সমতট (বাংলাদেশের নোয়াখালি-কুমিল্লা এলাকা) এবং ৫) হরিকেল (চট্টগ্রাম ও সন্নিহিত এলাকা, বাংলাদেশ)। ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের আগে এই পাঁচটি উপবিভাগের উপর কোনও একটি রাজশক্তির রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ছিল না। সামাজিক, আর্থিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে উপবিভাগগুলির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ক্রমেই উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। সাদৃশ্য যে এই বিভাগগুলির মধ্যে একেবারে নেই তা নয়। কিন্তু ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিতে বৈচিত্র সুপ্রচুর। অর্থাৎ আঞ্চলিক ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাচীন বাংলার অবস্থা একই সঙ্গে প্রাণবন্ত এবং জটিল। তার স্থানিক লক্ষণগুলির বিশেষ তাৎপর্য আছে।
প্রাচীনতম পর্ব থেকে ১২০০-১৩০০ খ্রি: পর্যন্ত বাংলা নামক ভূখণ্ডটির বহুমাত্রিক এবং জটিল অবস্থাটিকে পর্যালোচনা করার ও ফুটিয়ে তোলার আগ্রহে বাংলাদেশের এশিয়াটিক সোসাইটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছেন। ‘হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ’ এই গ্রন্থাবলিতে এ পর্যন্ত আলোচিত ও প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত এবং স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের গত চার দশকের ইতিহাস। ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশের এই সারস্বত প্রতিষ্ঠানটি এ বার উদ্যোগ নিয়েছেন বাংলার আদিপর্বের ইতিহাস রচনায় এবং তার পুনর্মূল্যায়নে। বলাই বাহুল্য, নিছক জাতিরাষ্ট্রের মাপকাঠিতে এই সুদূর অতীতকে ধরা অসম্ভব। কারণ তখন জাতিরাষ্ট্রের অস্তিত্বই ছিল না। তাই গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই ভূখণ্ডের উপবিভাগগুলির সম্যক ঐতিহাসিক পর্যালোচনা করাই দুই খণ্ডে বিধৃত গ্রন্থটির প্রধান লক্ষ্য। গোটা উপমহাদেশে এটি একমাত্র অ়ঞ্চল যা উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে সাগর পর্যন্ত প্রসারিত। জীবনের প্রায় এমন কোনও দিক নেই, যা সুদূর অতীতকাল থেকেই বাংলার নদনদী দ্বারা প্রভাবিত হয়নি।
বাংলাদেশের তরফে এই পদক্ষেপ নেওয়া হল, অথচ তা বাংলাদেশের বর্তমান ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে যে আটকে রাখা হল না, তাতে ইতিহাসবোধ যথাযথ মান্যতা পেয়েছে। ২০০২ সালে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি সিরাজুল ইসলামের সম্পাদনায় দশ খণ্ডে, ইংরেজি ও বাংলায় আলাদা করে ‘বাংলাপিডিয়া’ নামে যে কোষগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন, সেখানেও জাতিরাষ্ট্রের মাপকাঠিতে আলোচনা আটকে রাখা ছিল না। সেই প্রাথমিক প্রয়াসের পূর্ণতর পরিণত রূপ পাওয়া যাবে নতুন প্রকাশনাটিতে। যে উদ্দেশ্যে মহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এবং আহমেদ হাসান দানীর উদ্যোগে ঢাকায় এশিয়াটিক সোসাইটি গড়ে উঠেছিল, তাকে অন্তত আংশিক বাস্তবায়িত করাও এই নতুন ইতিহাস গ্রন্থটির আদর্শ। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসচর্চায় যাঁদের ভূমিকা অগ্রপথিকের, তাঁদের গবেষণা নতুন ইতিহাস গ্রন্থটির জন্য একই সঙ্গে ভিত্তি এবং প্রস্থানপর্ব। কালিদাস দত্তের কৃতিত্ব যেমন স্মরণীয় এ ক্ষেত্রে, একই ভাবে উজ্জ্বল হয়ে থাকে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রাধাগোবিন্দ বসাক, রমেশচন্দ্র মজুমদার, বিনয়চন্দ্র সেন, সরসীকুমার সরস্বতী, নীহাররঞ্জন রায়, দীনেশচন্দ্র সরকার, ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখের অসামান্য অবদান।
বস্তুত, রাজশাহির বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি এবং কলকাতার দুটি প্রতিষ্ঠান— বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, এশিয়াটিক সোসাইটি— না থাকলে এই জাতীয় প্রয়াস নেওয়াই অসম্ভব হত। অগ্রজ ইতিহাসবিদরা উনিশ এবং বিশ শতকে বাংলার অতীত উদ্ধারে ব্রতী হয়েছিলেন পরাধীন দেশের লুপ্ত গৌরব দর্শানোর অভীপ্সায়। বঙ্কিমচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথের ইতিহাসচেতনাও তাঁদের অনেকাংশেই উদ্বুদ্ধ করেছিল। তারই ফসল রাখালদাসের ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’, রমেশচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত ‘হিস্ট্রি অব বেঙ্গল’ (প্রথম খণ্ড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) এবং নীহাররঞ্জন রায়ের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’। গ্রন্থগুলির শিরোনাম থেকে বোঝা যাবে, নীহাররঞ্জন ছিলেন তাঁর সমকালীন ও পূর্বসূরি ইতিহাসবিদদের ধারণা এবং রীতিপদ্ধতির থেকে অনেকটাই আলাদা। তাঁর প্রধান অন্বিষ্ট অতীতের সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক জীবন, রাজবৃত্ত সেখানে গৌণ।
ইতিহাস রচনায় শেষ কথা বলে কিছু নেই, ইতিহাসের চূড়ায় সত্য প্রতিষ্ঠা করাও অসম্ভব। তাই নতুন আবিষ্কৃত তথ্যের আলোকে, অতীতের বাংলা নিয়ে নতুন কথা বলার সুযোগ যথেষ্ট। সেই কারণেই এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ দুই খণ্ডে ইংরেজিতে (অদূর ভবিষ্যতে বইটি বাংলাতেও প্রকাশিত হবে) বাংলার সুপ্রাচীন অতীতের সামগ্রিক আলোচনায় উদ্যোগী হয়েছেন। টাটকা, আকর তথ্য গত চার দশকে পরিমাণে বেড়েছে, আকর তথ্যের রকমফেরও উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে পুরাতাত্ত্বিক তথ্যপঞ্জি, লেখমালা, মুদ্রা এবং শিল্পসম্ভারের তথ্য উদ্ঘাটনে এ-পার ও-পার দুই বাংলাতেই বহু নতুন কথা জানা গিয়েছে। তাই পুরাতন এবং নব্যপ্রস্তর যুগে— বিশেষত লিখিত উপাদান আসার আগে— বাংলার মানুষের জীবন, জীবিকা, সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির ছবি আগের তুলনায় বদলে যেতে বাধ্য।
দুইটি বিষয়ে মন্তব্য এখানে দরকারি। প্রস্তর যুগে এবং তাম্রাশ্মীয় আমলে পশ্চিমবঙ্গের প্রত্ন সামগ্রীর সঙ্গে বিহার ও ঝাড়খণ্ডের সাযুজ্য যেমন দেখা যায়, তেমন বাংলাদেশের উত্তরপূর্ব এলাকার অতি প্রাচীন হাতিয়ার এবং তৈজসপত্রের সঙ্গে উত্তরপূর্ব সীমান্তবর্তী অ়ঞ্চল এবং মায়ানমারের বস্তুগত সংস্কৃতির তালমিলও নজরে পড়বে।
দ্বিতীয়ত, সাম্প্রতিক গবেষণা পদ্ধতি অনুযায়ী পুরাবস্তু কেবলমাত্র প্রাগিতিহাসের মানুষকে বোঝার জন্য জরুরি নয়। লিখিত তথ্যরাজি থাকলেও উৎখনন এবং অনুসন্ধান থেকে পাওয়া প্রত্নবস্তুর সাক্ষ্য একান্ত প্রয়োজন নগরায়ণ বোঝার জন্য। তাই বাংলার প্রাচীনতম তিনটি নগরের পরিচয় পাওয়া যাবে বাণগড় (পশ্চিমবঙ্গ), মহাস্থান (বাংলাদেশ) এবং ওয়াড়ি বটেশ্বর-এর (ঢাকার কাছে) উৎখনন থেকে। অনেকগুলি লেখ এবং তাম্রশাসনের পাঠোদ্ধার করা হয়েছে সাম্প্রতিক দশকগুলিতে। আগে ইতিহাসবিদগণ মূলত লেখ/তাম্রশাসনের সাক্ষ্য ব্যবহার করতেন রাজবংশের ইতিহাস লেখার জন্য। এখন লেখমালার আলোকে রাজবৃত্ত ছাড়াও নিয়মিত রচিত হয় সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাস।
একটি-দু’টি উদাহরণ দেওয়া যাক। ৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বিক্রমপুরের চন্দ্রবংশীয় শাসক শ্রীচন্দ্র (৯২৫-৭৫ খ্রি.) শ্রীহট্টে এক বিশাল ব্রাহ্মণ নিবেশন (‘ব্রহ্মপুর’) তৈরি করার জন্য তাম্রশাসন জারি করে জমিজমা দিলেন। ছয় হাজার ব্রাহ্মণের বসতির ব্যবস্থা হল সেখানে। কিন্তু ব্রাহ্মণ তো কায়িক শ্রম করেন না। তাই জমি বরাদ্দ হল কায়স্থ (করণিক) গণক (হিসাবরক্ষক), স্থপতি, বৈদ্য প্রভৃতি পেশাদারদের জন্য। তারই সঙ্গে থাকলেন বহু কর্মকার, কুম্ভকার, শঙ্খবাদক, ঢক্কাবাদক, নাপিত, কর্মকার, এমনকি ভৃত্য (কর্মকর) এবং দাসী (চেটিকা)। উপাস্য দেবতাদের মধ্যে আছেন বিরলদর্শন ব্রহ্মা। সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক হল অগ্নি, মহাকাল, যোগেশ্বর এবং জৈমিনীর (শেষোক্ত জন পূর্বমীমাংসাকার দার্শনিক, দশম শতকে শ্রীহট্টে দেবতায় পর্যবসিত) উপাসনা। উপাস্য দেবতা অভিন্ন হলেও দুটি ভিন্ন মঠে তাঁদের আরাধনার ব্যবস্থা হল: একটি বঙ্গালদেশীয়দের মঠ, অপরটি দেশান্তরীয় মঠ। বাইরে থেকে শ্রীহট্টে লোক এসেছিল, তা বোঝাই যায়। হয়তো কিছু সামাজিক-সাংস্কৃতিক টানাপড়েনও ঘটে থাকবে, তাই ভিন্ন ভিন্ন মঠে অভিন্ন দেবতাসমূহের আরাধনার এক বিচিত্র নজির রয়ে গেল। লক্ষণীয় যে, রাজা শ্রীচন্দ্র বৌদ্ধ; যাঁর বিশেষ অনুরোধে ব্রহ্মপুরের জমি মঞ্জুর হল, তিনি এক বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ। অথচ ব্রহ্মপুরে উপাসনার ব্যাপারে বুদ্ধ ও বিষ্ণুর উপস্থিতি পর্যন্ত নেই। এক বহুমাত্রিক রংদার এবং জটিল পরিস্থিতির সাক্ষ্য এখানে হাজির।
ধর্মাচরণের জন্য নিষ্কর ভূসম্পদ দেওয়ার রাজকীয় তথা প্রশাসনিক দলিলের সংখ্যা প্রচুর। পুণ্ড্র এবং রাঢ় এলাকায় এক জন বা কয়েক জন ব্রাহ্মণের উদ্দেশে নিষ্কর জমি দেওয়ার নজির বেশি, মেঘনা নদীর পূর্ব দিকে একই রকম ভূমিদানের ক্ষেত্রে প্রবণতা ভিন্ন। দানগ্রহীতা সাধারণত কোনও ব্যক্তি নন, বরং কোনও ধর্মপ্রতিষ্ঠান (মঠ বা বিহার)। জমি দানের দলিলের একেবারে শেষ দিকে জমির সীমানা সংক্রান্ত খুঁটিনাটি বিবরণ থাকে। আপাত-নীরস সেই তথ্য নিষ্কাশন করে ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় যে অভিনব গবেষণা করেন, তা থেকে গ্রামীণ এলাকার বসতি-বিন্যাস মূর্ত হয়ে ওঠে। গ্রামগুলি দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন, আবদ্ধ এবং স্বয়ম্ভর নয়, বরং একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং পরস্পর নির্ভরশীল ছিল। তাই এই সিদ্ধান্তটি চমকে দেওয়ার মতো।
আঞ্চলিক বৈচিত্রের আর এক উদাহরণ মুদ্রা ব্যবস্থায়। খ্রি: ষষ্ঠ-সপ্তম শতক থেকে বাংলার স্বর্ণমুদ্রায় খাদের পরিমাণ বেড়েই চলেছে, অষ্টম শতক থেকে সোনার টাকা কার্যত উধাও হয়ে গেল। নীহাররঞ্জন রায় এবং রামশরণ শর্মা স্বর্ণমুদ্রার অদর্শনে দূরপাল্লার সমুদ্রবাণিজ্যের অধোগতি দেখেছিলেন। পাল-সেন বংশীয় রাজারা মুদ্রা জারি করায় অনীহা দেখালেও, সমতট-হরিকেল অ়ঞ্চলে সপ্তম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত উচ্চমানের রৌপ্যমুদ্রার ব্যবহার ছিল অব্যাহত। দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য উপাদান ছিল কড়ি। এই কড়ি কিন্তু বাংলায় পাওয়া যায় না। তা আসত সুদূর মলদ্বীপ থেকে জলপথে।
দৈনন্দিন জীবনের যে ছবি এক কালে ফুটিয়েছিলেন নীহাররঞ্জন রায়, তা বর্তমানে আরও সমৃদ্ধ হয়েছে চন্দ্রকেতুগড়, তাম্রলিপ্ত এবং ময়নামতী (কুমিল্লা, বাংলাদেশ) থেকে আবিষ্কৃত ভূরি পরিমাণ পোড়ামাটির ভাস্কর্যের দ্বারা, যাতে শিল্পের দেশজ ছাপটি বিধৃত। শিল্পকলা তো বটেই, ধর্মীয় জীবন বোঝার জন্যও প্রতিমাগুলির উপযোগিতা প্রশ্নাতীত। ধর্মীয় জগতে বৌদ্ধধর্ম কী ভাবে ক্রমে গৌণ হয়ে গেল ব্রাহ্মণ্য-পৌরাণিক ভক্তিমূলক সম্প্রদায়ের দাপটে, তা-ও এক জটিল ও বর্ণময় কাহিনি। এখানে উল্লেখ করা উচিত, নালন্দা, বিক্রমশীলা এবং সোমপুর বিহার যখন অবসন্ন, তখনও কিন্তু ময়নামতী এবং চট্টগ্রাম এলাকায় বৌদ্ধধর্ম যথেষ্ট সজীব। অতি সম্প্রতি আবিষ্কৃত একটি লেখ জানান দেয় যে খ্রি: পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকে কুমিল্লা-নোয়াখালি এলাকায় সক্রিয় ছিল আজীবিক নামক শ্রমণগোষ্ঠীর একটি ধর্মপ্রতিষ্ঠান। এর আগে বাংলায় আজীবিকদের উপস্থিতি এত স্পষ্ট ভাবে জানা ছিল না।
এই সব আনকোরা নতুন তথ্যের আলোকে, পূর্বসূরিদের কাজকে খতিয়ে দেখে নতুন কথা বলার সুযোগ তথা প্রয়োজনীয়তা আছে। কিন্তু এই কর্ম কোনও এক ব্যক্তির সাধ্যাতীত, এর জন্য দরকার সামূহিক প্রচেষ্টা। তাই এই কাজে শামিল হয়েছেন বাংলাদেশ, ভারত, জাপান, চিন, ফ্রান্স, জার্মানি ও মার্কিন দেশের বিশেষজ্ঞরা। প্রথম খণ্ডে থাকছে প্রাচীন জনগোষ্ঠী তথা কৌমগুলির পরিচয়— অনেকটাই নৃতত্ত্বের ভিত্তিতে। আর আছে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান-আশ্রিত দীর্ঘ আলোচনা। দ্বিতীয় খণ্ডে সন্নিবিষ্ট হয়েছে বর্ণ-জাতিতে বিভাজিত অসাম্য-চিহ্নিত সমাজ, নারীর অবস্থান, দৈনন্দিন জীবনযাপন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মুদ্রাব্যবস্থা, ধর্মীয়-জীবন (ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ এবং জৈন সম্প্রদায়), শিল্পকলার কথা (স্থাপত্য-ভাস্কর্য, চিত্রকলা, মূর্তিতত্ত্ব), সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (সংস্কৃত, প্রাকৃতে রচিত এবং অবশ্যই চর্যাপদের পর্যালোচনা)। থাকছে অনেকগুলি মানচিত্র এবং আলোকচিত্র। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপিকা রোমিলা থাপারের মুখবন্ধ এবং বিশিষ্ট অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের প্রাককথন বইটিকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে।
জাতীয়তাবাদী জিগিরে যখন বিভেদ জাগিয়ে তোলা হচ্ছে, যখন বহুর মধ্যে এক খোঁজার মেঠো বুলি দিয়ে সব কিছু একাকার করে দেওয়ার দুরভিসন্ধি দেখা যাচ্ছে—তখন জাতিরাষ্ট্রের সঙ্কীর্ণ গণ্ডিকে অতিক্রম করার এ এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। আনন্দবাজার পত্রিকার দ্বাদশ বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে (১৯৩৩) রবীন্দ্রনাথ আহ্বান জানিয়েছিলেন: ‘স্বদেশেরে চাও যদি তারো ঊর্দ্ধ্বে ওঠো/ কোর না দেশের কাছে মানুষেরে ছোটো।’
জাতীয়তাবাদের চিৎকৃত এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের ওই উচ্চারণটিই দুই বাংলার ইতিহাসবিদদের এই উদ্যোগের চালিকাশক্তি।
_____★______★_____★____
২টি মন্তব্য:
সুন্দর
Nice
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন